‘পথের পাঁচালী’ অপছন্দ, সত্যজিতের আড্ডায় নারাজ কমলকুমার

১৯৪৮ সাল। ‘দ্য রিভার’ ছবির শ্যুটিংয়ের জন্য কলকাতায় এসেছেন ফরাসি চিত্রপরিচালক জ্যঁ রেনোয়া। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে চলে সিনেমার দৃশ্যগ্রহণের বিভিন্ন খুঁটিনাটি কাজ। বাইরে যাওয়া বলতে ব্যারাকপুরের গঙ্গার পারে লোকেশন দেখতে যাওয়া। রেনোয়ার সঙ্গে প্রায়ই দেখা করতে আসতেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। শালপাতার ঠোঙায় নকুড়ের কড়াপাকের সন্দেশ উপহার দিয়ে আলাপ শুরু দুজনের। রেনোয়ার কাজকর্ম দেখে কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন সেই ব্যক্তি। বাংলাদেশের উপর ছবি হচ্ছে, অথচ এঁরা তো প্রায় সারাদিনই হোটেলে বসে থাকেন। এভাবে কি বাংলাকে চেনা যায়? তাকে চিনতে হলে, আত্মস্থ করতে হলে লোকজনের সঙ্গে মিশতে হবে, রাস্তাঘাটে ঘুরে রোদে পুড়তে হবে। অর্ধভুক্ত হয়ে জিরিয়ে নিতে হবে কোনো বটগাছের তলায়। আর দুচোখ ভরে দেখতে হবে গঙ্গার রূপ। তবেই তো বঙ্গপ্রকৃতির সম্পূর্ণ রূপ ফুটে উঠবে সিনেমায়।

সেই ভদ্রলোকের নাম কমলকুমার মজুমদার (Kamal Kumar Majumdar)। কথাসাহিত্যিক হিসেবে অধিক বিখ্যাত হলেও সিনেমা, নাটক, চিত্রকলা সর্বত্র অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। ১৯৪২ সাল নাগাদ কাজের খোঁজে রিখিয়া থেকে ফিরে আসেন কলকাতায়। কিছুদিন ছিলেন রিলিফ কর্মে। নিজের একটা ব্যবসা ছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে যায় বিভিন্ন কারণে। এদিকে বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে চলছে এক বিশৃঙ্খল সময়। বেকার কমলকুমার কাজ শুরু করলেন ফ্রিল্যান্স বিজ্ঞাপন শিল্পী হিসেবে। এই সময়েই সম্ভবত আলাপ সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit ray) সঙ্গে। দুজনেই যুক্ত হলেন রেনোয়ার সিনেমায়। বাংলার নদী-মাঠ ঘুরে হাতে-কলমে আয়ত্ত করেন চলচ্চিত্র বানানোর শিক্ষা।

১৯৫০-এ গড়ে উঠল ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। সত্যজিৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, রাধাপ্রসাদ গুপ্তদের সম্পাদনায় সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘চলচ্চিত্র’ পত্রিকা। মেতে উঠলেন কমলকুমারও। ঠিক হল, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’-র চিত্ররূপ দেওয়া হবে। সদ্য হলিউড ফেরত হরিসাধন দাশগুপ্ত হবেন পরিচালক, চিত্রনাট্য রচনা করবেন সত্যজিৎ এবং শিল্পনির্দেশনার দায়িত্বে কমলকুমার। তিনি নাকি এক হাজারেরও বেশি স্কেচ তৈরি করেছিলেন ‘ঘরে বাইরে’-র। যদিও অনেক অনুরোধেও সেই স্কেচ দেখার সৌভাগ্য হয়নি কারোর। একমাত্র স্ত্রী দয়াময়ীর মুখে শোনা গেছে উৎকণ্ঠিত বিমলার একটি স্কেচের কথা। অবশ্য অন্য আরেকটি মতে, ফিল্ম সোসাইটির পক্ষ থেকে নয়, তার বছর চারেক আগেই শুরু হয় এই সিনেমার পরিকল্পনা। 

‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে কমলকুমারের আকর্ষণ ছিল প্রায় ব্যক্তিগত পর্যায়ের। নিখিলেশ তাঁর কাছে ছিল ‘ক্রাইস্ট ফিগার’। মাথায় যেন কাঁটার মুকুট। এর পাশাপাশি শরৎচন্দ্রের ‘অভাগীর স্বর্গ’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার জন্ম’ নিয়েও চলচ্চিত্র তৈরির ইচ্ছে ছিল কমলকুমারের। কিছু স্কেচও করেছিলেন। ‘অভাগীর স্বর্গ’-এর সূচনার দৃশ্যটি ছিল “জমিদার গৃহিণীর শবযাত্রা দিয়ে। দু’পাশে কলাবন, মাঝখানের পথ দিয়ে শবযাত্রা চলছে কীর্তনের সঙ্গে। ঝোড়ো বাতাসে কলাপাতা আন্দোলিত হচ্ছে, রাস্তা থেকে খই উড়ে গিয়ে মাঠে পড়ছে।”

আরও পড়ুন
সিনেমায় চশমা-পরা ব্যোমকেশ, সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে অখুশি শরদিন্দু

অথচ বছর কয়েকের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে কমলকুমার ও সত্যজিৎ রায়ের। কোথাও গিয়ে হয়তো পার্থক্য তৈরি হচ্ছিল দুজনের দৃষ্টিভঙ্গির। কুরোসওয়ার ‘রশোমন’ দেখে সবাই মুগ্ধ, কিন্তু কমলকুমার শুধু প্রশংসা করলেন একটি দৃশ্যের। ওই যেখানে নদীর পাশ দিয়ে পুলিশটি ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে যাচ্ছে, সেই জায়গাটা ভালো। প্রায় একই রকম মন্তব্য করেন সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা দেখেও। প্রথমে তো সিনেমাটি দেখতে কোনো উৎসাহ বোধ করেননি। পরে দেখলেও জনৈকের কাছে প্রশংসা শোনা যায় শুধু চিনিবাস ময়রা আর অপু-দুর্গার দৃশ্যটির।

আরও পড়ুন
চুল কেটে এসেছেন হরিহর, ‘পথের পাঁচালী’র শুটিং বাতিল সত্যজিতের

সত্যজিৎ অবশ্য বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন যে গ্রামীণ জীবন নিয়ে সিনেমা নিয়ে কমলকুমারকে সন্তুষ্ট করার ক্ষমতা সত্যিই তাঁর নেই। দুজনেই মৌনতা অবলম্বন করেছিলেন এ বিষয়ে। তবে রবি ঘোষের লেখায় পাওয়া যায় দুজনের সাক্ষাতের একটি বিবরণ। তাঁর স্ত্রী অনুভার শ্রাদ্ধবাসরে দেখা হয় দুই পুরনো বন্ধুর। সত্যজিৎ অনুরোধ জানান কমলবাবুকে একদিন তাঁর বাড়িতে আড্ডা মারতে আসার জন্য। উত্তর আসে, “আপনার বাড়িতে আজকাল বড্ড বেশি ভদ্দরলোকেরা আসেন, তাই যেতে পারি না।” ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন সত্যজিৎ রায়ও, “ঠিক আছে যেদিন আসবেন, আগে ফোনে জানাবেন, চাডডি ছোটোলোক আনিয়ে রাখব।” নিছকই রসিকতা? নিরাপদ দূরত্বে থেকে পুরনো সম্পর্ককে একবার হাস্যরসে ঝালিয়ে নেওয়া? নাকি চাপা উষ্মা রয়েছে দুপক্ষের তীক্ষ্ণ কথোপকথনে? যেভাবে খুশি দেখা যেতে পারে বিষয়টি। তবে এটাও ঠিক যে, সত্যজিতের সিনেমা থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেননি কমলকুমার। আবার নিয়মিত তাঁর খোঁজখবরও রাখতেন সত্যজিৎ। বাংলার সংস্কৃতির দুই বিদগ্ধ মানুষের অভিমানের মধ্যেও বোধহয় এভাবেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা লুকিয়ে থাকে।

ঋণস্বীকার :
কমলবাবু, সত্যজিৎ রায়
আড্ডার মজা, রবি ঘোষ

Powered by Froala Editor