সুন্দরবন ডুবছে, জল ফুরোচ্ছে আর বিশ্ব জুড়ে ভিড় বাড়ছে 'জলবায়ু উদ্বাস্তুদের'

রহমানের বাড়ি সুন্দরবনের মৌসুনি দ্বীপে। বয়স বছর তিরিশ। গত প্রায় ষোলো বছর ধরে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, হায়দ্রাবাদ, দিল্লি ঘুরে এখন বজবজের গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে রহমান। রহমানের স্ত্রী আমিনা। যেটুকু সুখ-দুঃখের কথা তা ফোনেই সারতে হয়। দেখা হয় তিন-চার মাস বাদে বাদে। সেও তিন-চার দিনের জন্য।

মৌসুনি ধীরে ধীরে জলে তলিয়ে যেতে চলেছে। মৌসুনির তলিয়ে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। সারা পৃথিবীতে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে সমুদ্রের জলস্তর যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার চেয়ে দ্রুত হারে জলস্তর উঁচু হচ্ছে সুন্দরবনে। তার ওপর, মৌসুনির মাটি ইতিমধ্যেই নুনে ভর্তি হয়ে গেছে। খাওয়ার জলেও নুন।

বাঙালির সপ্তাহান্তের ভ্রমণের ঠিকানা মৌসুনির বাসিন্দারা দিন গুণছেন রিফিউজি হওয়ার। অনেকের ক্ষেত্রেই জীবদ্দশায় দ্বিতীয়বার। প্রথমবার রাজনৈতিক কারণে। আর দ্বিতীয়বার? একটা শব্দ ইদানীং শোনা যাচ্ছে খুব - ক্লাইমেট রিফিউজি। প্রথমবার না-হয় মানুষই ঠিকানা করে দিয়েছিল। মনুষ্যত্ব বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশভাগের ব্যথা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সে ব্যথা খানিক উপশমও হয়েছিল বলে অনেকে বলেন। কিন্তু এবার দেশের মানুষই জায়গা দেবেন তো?

যারা যাদবপুর কিংবা শিয়ালদা অঞ্চলে থাকেন, আয়লার পর ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসা সুন্দরবনের অসংখ্য মানুষকে স্টেশনে কিংবা বাসস্ট্যান্ডের চাতালে ঠাঁই নিতে দেখেছেন তাঁদের অনেকেই। ভিক্ষেই সেইসব ছিন্নমূল মানুষদের ‘অনিবার্য’ পরিণতি হয়েছে। তাদের কাছে কোনো কাগজ আর বেঁচে নেই। নাগরিক হওয়ার প্রমাণপত্র, শিক্ষার দলিল, বাসার কাগজ… আয়লা সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

বাংলায় আজই এনআরসি লাগু হলে সবার আগে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবেন এই মানুষগুলোই। যদিও শহরে তাঁরা যেভাবে থাকেন, তা সেটা ডিটেনশন ক্যাম্পের মতোই প্রায়। উচ্ছল শৈশব নেশার তোড়ে মৃত। এদেরকেও ওই নামেই ডাকা যায় জানেন - ক্লাইমেট রিফিউজি।

কে জায়গা দিয়েছে এদের? সরকার? আমি? আপনি? তাহলে মৌসুনিবাসীদের কে দেবে জায়গা?

পশ্চিম আর মধ্য ভারতের কিছু কিছু গ্রাম ইতিমধ্যে পুরোটাই বাস্তুহারা হয়ে উঠে গেছে। স্থানীয় মানুষজন কোথায় গেছে, সে বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য সরকারও জোগাড় করেনি। ‘হিন্দুরাষ্ট্র’-র স্বপ্ন যারা দেখে, তারাও তীব্র জলসঙ্কটে উদ্বাস্তু হয়ে পড়া এই বিপুল ‘হিন্দু’ জনতার খোঁজ রাখেনি। ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ যদি স্বাস্থ্যকর পানীয় জল শূন্যতার দিকে যাত্রা করে, তবে ব্যাপক উন্নয়নের সেই রাষ্ট্রে হিন্দুরাও শান্তিতে থাকতে পারবেন তো? শ্মশানের শান্তি নয়, স্বপ্নের শান্তির কথা বলছি।

নদী-নালা-পাহাড়-জঙ্গল-মাটি-আকাশ-বাতাস ধ্বংস করে ‘বিকাশ’ বা উন্নয়ন যাদের জন্য, সেই ‘বিকাশ’ তাদের সইবে তো? একই জায়গায় একই বছরে খরা এবং বন্যা ফিরে ফিরে এলে তা বাসযোগ্য থাকে আর? মহারাষ্ট্র, আসাম, তামিলনাড়ু… যে বাঘটাকে আসামে মানুষের বাড়ির সোফায় বসতে দেখা গিয়েছিল সেও যে ক্লাইমেট রিফিউজি!

পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে ফিজি দ্বীপপুঞ্জের উত্তরের দ্বীপ কিরিবাতি আর ট্রুভ্যালু। আর খুব বেশি হলে ২০ বছর। দেশে দেশে বলগাহীন বিষবায়ু নিঃসরণের ফল কিরিবাতি আর ট্রুভ্যালু পেতে চলেছে। সেখানকার বয়স্করা কিছুতেই দ্বীপ ছেড়ে যাবেন না। কুড়ি বছর পর তাদের কথা যাতে সারা পৃথিবী মনে রাখে, সে জন্য তারা এখন থেকেই গল্প রচনা করছেন। ফিজি দ্বীপপুঞ্জের শাসক তাদের ঠিকানা দেবে বললেও তারা সেখানে যেতে চান না। দেশহারা, বাস্তুহারা, সংস্কৃতিহারা, ভাষাহারা এক অনিশ্চিত বিপদসংকুল ভবিষ্যতের সামনে আজ তারা দাঁড়িয়ে, যার দায় তাদের একেবারেই নেই বললে খুব একটা অত্যুক্তি হয় না বোধহয়।

কিরিবাতি যেন মানবসভ্যতার বিবেক। কুড়ি বছর পর কি সভ্যতা বিবেকহীন হবে নাকি সচেতন মানুষ নতুন করে বিবেকবান হবে?

জলবায়ু উদ্বাস্তুরাই আজ পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে বড় সঙ্কট সম্ভবত। শুধুমাত্র দ্বীপ-অঞ্চল নয়, দেশের ভিতরেও তা বড় আকারে সত্যি। মিথ্যে আধুনিকতার নামে, উন্নয়নের নামে যে প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে দেশে দেশে তা মানুষকে জঙ্গল থেকে, নদীতীর থেকে, পাহাড় থেকে উৎখাত করছে। ভারসাম্যহীনতার ধীর বিষক্রিয়া প্রকৃতিকে আর মানববহনযোগ্য করে রাখছে না। দাবানল, জলসঙ্কট, পাহাড় ক্ষয়ে যাওয়া, বৃষ্টিহীনতা, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি ভাববার চেয়ে দ্রুতগতিতে আমাদের চিরউদ্বাস্তু হওয়ার জমিকে আরও শক্ত করছে।

এবং বাস্তুতন্ত্রের এহেন পরিবর্তনকে ভারসাম্যহীনতার জায়গায় পৌঁছে না-যেতে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণাও হচ্ছে না তেমন। তাতে খরচ হলে হবে। টাকার জন্য মানুষ নাকি মানুষের জন্য টাকা? ভবিষ্যতের পৃথিবী ক্লাইমেট রিফিউজিতে ভরে গেলে তার দায় কে নেবে? সাধারণ মানুষের ছুটকো জল নষ্ট করা আর দূষণকারী পাপীদের নদী বিষিয়ে দেওয়া কিংবা ভূ-গর্ভস্থ জল শূন্য করে দেওয়া কি একইরকম অন্যায়?

কী হতে চলেছে তা কারোরই জানা নেই। তবে ইচ্ছে থাকলেই পরিস্থিতিকে হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া থেকে নিশ্চিত আটকানো যায়। না হলে?

না হলে আর কী? আমাজনীয় অববাহিকার, গাঙ্গেয় অববাহিকার আর সিন্ধু অববাহিকার জলবায়ু উদ্বাস্তুদের কোনও এক অজানা ঠিকানায় দেখা হবে। আলাপ, পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে তারা বুঝবে যে তারা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান কিছুই নয়, তারা সবহারা মানুষ। একে অপরের অবশ্যম্ভাবী বন্ধু। গোটা পৃথিবীটাই তাদের দেশ। আর তাদের শত্রু? না, থাক…