প্রয়াত ‘সিটি অফ জয়’-এর লেখক ডমিনিক লাপিয়েঁর

‘সিটি অফ জয়’। কল্লোলিনী কলকাতা এই নামেই পরিচিত গোটা বিশ্বে। বাংলা তো বটেই, গোটা পূর্বভারতের শিল্প-সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র হওয়ায়, এই নাম কলকাতার সঙ্গে বেশ যুতসই-ও বটে। তবে কলকাতার উৎসব-মুখরতার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থা এই নাম দেয়নি তিলোত্তমাকে। বরং এই নাম উঠে এসেছিল এক ফরাসি লেখক, ডমিনিক লাপিয়েঁর-এর (Dominique Lapierre) লেখা গ্রন্থ থেকে। 

গতকাল ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ‘সিটি অফ জয়’-খ্যাত কলকাতা-কেন্দ্রিক ফরাসি উপন্যাসের লেখক। দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে। ছিল শ্বাসকষ্ট ও হৃদযন্ত্রের সমস্যাও। 

১৯৩১ সাল চ্যাটেইলোনে জন্ম লাপিয়েঁর-এর। সেখানেই বড়ো হয়ে ওঠা তাঁর। তবে পরবর্তীতে কর্মসূত্রে একাধিকবার দেশের বাইরে ছুটেছেন তিনি। পথে পথে ঘুরে তুলে এনেছেন ঝলমলে সাজানো শহরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার বাস্তবের গল্প। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম নন-ফিকশন গ্রন্থ ‘ইজ প্যারিস বার্নিং?’। বিশ্বযুদ্ধকালীন নাৎসি জার্মানির অধিগ্রহণে থাকা প্যারিসের ছবিই ফুটে ওঠে এই গল্পে। পরবর্তীতে এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল সিনেমাও। 

প্যারিসের মতোই, সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের গল্প খুঁজতে খুঁজতে কলকাতাতেও হাজির হন লাপিয়েঁর। কলকাতার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বুঝতে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। পরবর্তীতে সেই অভিজ্ঞতাই তাঁর বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে ‘সিটি অফ জয়’-খ্যাত উপন্যাসটির। তবে ‘সিটি অফ জয়’-এর গল্প সুখকর নয় মোটেই। বস্তিজীবনের যন্ত্রণা, হিংসা, আর্থিক অনটন— প্রতিটি ক্ষেত্রই দগদগে ঘা হয়ে ফিরে এসেছিল এই গ্রন্থে। তাহলে এই উপন্যাসের শিরোনামে কেন জায়গা করে নিয়েছিল ‘জয়’?

আদতে এই গল্পের প্রেক্ষাপট কলকাতা সংলগ্ন হাওয়ার একটি বস্তি। আর সেই বস্তির নাম ছিল ‘আনন্দনগর’। এই আনন্দনগর-ই ফরাসি অনুবাদে হয়ে যায় ‘সিটি অফ জয়’। ১৯৮৫ সালে এই গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও, তাতে বর্ণিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলের ইতিহাস। দৈনিক নিপীড়ন, নির্যাতন, শোষণ, অস্পৃশ্যতা এবং বৈষম্যের কাহিনি। মাদার টেরেসা মিশনের কথাও উল্লেখিত হয়েছে সেখানে। উল্লেখিত হয়েছে সামাজিক জীবনকে বদল করতে মিশনারির অবদানের কথাও। 

বিশ্বজুড়ে বিক্রি হয়েছিল ব্যাঙ্গাত্মক এই উপন্যাসের প্রায় ১০ লক্ষের বেশি কপি। তবে সাফল্যের সঙ্গে পিছু ছাড়েনি বিতর্কও। ১৯৯২ সালে এই উপন্যাসের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু হলে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে কলকাতা-জুড়ে। জনরোষের সম্মুখীন হতে হয়েছিল অমরেশ পুরি, শাবানা আজমির মতো তারকাদের। শব্দবাণে আক্রান্ত হয়েছিলেন ডমিনিক লাপিয়েঁর-ও। দাবি করা হয়েছিল, এই গ্রন্থ বাঙালি তথা সমস্ত ভারতীয়ের কাছেই অবমাননাকর। 

তবে কলকাতায় অপরাধ-হিংসা-মারামারি-দারিদ্র-বৈষম্য আছে— এ-কথা কি সত্যিই অস্বীকার করার জায়গা আছে? জাঁকজমকের আড়ালে ধুঁকতে থাকা সেই মহানগরীরই আখ্যান ‘সিটি অফ জয়’। কলকাতার ‘সিটি অফ জয়’ তকমার সঙ্গেও বোধহয় ব্যাঙ্গাত্মকভাবেই মিশে রয়েছে সেই আঙ্গিকটিও।

মজার বিষয় হল, এই প্রবল সমালোচনার পরও ‘সিটি অফ জয়’ বিক্রির লভ্যাংশ কলকাতায় মানবিক ও সামাজিক কাজের জন্য দান করেছিলেন লাপিয়েঁর। তবে শুধু কলকাতাই নয়, গোটা ভারতের সঙ্গেই চিরকাল ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। ঘনিষ্ঠতা ছিল নিচু তলার মানুষের সঙ্গে। ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ভোপাল গ্যাস-দুর্ঘটনার ওপর নির্মিত তাঁর শেষ উপন্যাস ‘ফাইভ পাস্ট মিডনাইট ইন ভোপাল’। এই গ্রন্থটি রচনার জন্যেও ইন্দোর ও ভোপালে দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন তিনি। সমীক্ষা করেছেন সাধারণ মানুষদের ওপর। পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁদের জীবনযাত্রা। পাশাপাশি ভোপালের ওরিয়া বস্তি অঞ্চলে স্থাপন করেছিলেন একটি প্রাইমারি স্কুল। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিয়ম করেই এই স্কুলের তহবিলে অর্থসাহায্য প্রদান করতেন তিনি। এমন একজন ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে যেন মুছে গেল ফরাসি ও ভারতীয় সাহিত্যের একটি সেতু…

Powered by Froala Editor