যৌনপল্লীর শিশুদের নিয়েই ‘বসে আঁকো প্রতিযোগিতা’, পুজোয় ব্যতিক্রমী দৃশ্য কলকাতায়

ওরা এঁকেছে স্বদেশের মুখ। যে দেশ আমাদের খুব কাছে থেকেও প্রায় অচেনা। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর শুরু হয় যৌনপল্লীর মাটি দিয়ে। কিন্তু উৎসবের আতিশয্যে তাঁরা আড়ালে চলে যান। আড়ালেই তো থাকেন সারা বছর। সপ্তমীর সকালে নলিনী মিত্র স্ট্রিটে ১৫০টি শিশু একসঙ্গে বসেছিল রং-পেন্সিল হাতে। এদের প্রত্যেকের জন্ম যৌনপল্লীর মাটিতে। উৎসবের দিনগুলিতে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেই এগিয়ে এল ‘ক্যালকাটা ফুডিজ ক্লাব’। প্রতি বছরের মতো এবার ‘ছোটদের সেরা দুর্গা’ অনুষ্ঠান করা যায়নি। করোনা পরিস্থিতিতে বন্ধ মণ্ডপ পরিক্রমা। আর তাই এবারের অনুষ্ঠান হল একটু অন্যভাবে।

“কারোরই ছবি আঁকার কোনো প্রথাগত শিক্ষা নেই। তবু এক একজনের ছবি আমাদের সত্যিই অবাক করেছে।” বলছিলেন ‘ক্যালকাটা ফুডিজ ক্লাব’-এর ট্রাস্টি চন্দন গুপ্ত। তিনটি বিভাগে তিনজন প্রতিযোগীকে পুরষ্কৃতও করা হয়। তবে সে তো শুধুই নিয়মমাফিক। আসলে পুজোর আনন্দের খানিকটা সকলের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া। এই উদ্যোগের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘দুর্বার’। সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি, খিদিরপুর সহ কলকাতার নানা যৌনপল্লী থেকে ১৫০ জন শিশুকে এক জায়গায় নিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। ‘বসে আঁকো’ প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ছিল একটু খাওয়াদাওয়ার আয়োজনও।

সল্টলেকের মৃত্তিকা ভবন থেকেই এসেছিল দুপুরের খাবারের আয়োজন। এই করোনা পরিস্থিতিতেই কিছুদিন আগে পঞ্চায়েত দপ্তরের ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের অধীনে এখানে কাজ শুরু করেছেন কিছু প্রাক্তন যৌনকর্মী। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে খাবার বিতরণ, সবেরই দায়িত্ব তাঁদের উপরে। সপ্তমীর সকালে তাঁদের রান্না করা খাবারই তুলে দেওয়া হল ১৫০ জন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের হাতে। “কয়েকজন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। আর তাঁরাই এই ছোট্ট শিশুদের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল এভাবেই।” বলছিলেন চন্দন গুপ্ত।

বিগত ২ বছর ধরে কলকাতা শহরের বুকে সামাজিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে পুজো পরিক্রমার আয়োজন করে ‘কলকাতা ফুডিজ ক্লাব’। সেইসব শিশুদের বিচারেই বেছে নেওয়া হয় সেরা দুর্গাপুজো। অনুষ্ঠানের নাম, ‘ছোটদের সেরা দুর্গা’। তবে এবছর করোনা পরিস্থিতিতে সেই অনুষ্ঠান সম্ভব হল না। তাই তৃতীয় বর্ষের আয়োজন হল অন্যভাবে। পঞ্চমীর দিন সকালে উল্টোডাঙার ‘সোপান’ স্কুলের ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দেওয়া হল পুজোর নতুন জামাকাপড়। সপ্তমীর আয়োজন হল যৌনপল্লীর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর অষ্টমীর দিন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘হোপ’-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া শিশুদের নিয়েই হল মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। ‘ক্যালকাটা ফুডিজ ক্লাব’ তো শুধু খাদ্যরসিকদের একটা আড্ডা দেওয়ার জায়গা নয়। একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আর এই মহামারী পরিস্থিতিতেও বারবার নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব প্রমাণ করেছেন তাঁরা। উৎসবের দিনগুলিতে এক অন্য ধারার আয়োজনের সাক্ষী থাকল শহর কলকাতা।

Powered by Froala Editor