গৃহযুদ্ধে বিরতি, আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট ঘিরে ঐক্যবদ্ধ ক্যামারুন

আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূল ঘেঁষা আফ্রিকার ছোট্ট রাষ্ট্র ক্যামারুন (Cameron)। মেরে কেটে বড়োজোর আড়াই কোটি মানুষের বসবাস। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই দেশটিকে দ্বিবিভক্ত করেছে গৃহযুদ্ধের (Civil War) পরিস্থিতি। এমনই সামাজিক ও রাজনৈতিক টালবাহানার মধ্যে ফুটবল নতুন করে যেন ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে ক্যামারুনকে। 

গত ৯ জানুয়ারি থেকেই শুরু হয়েছে আফ্রিকা কাপ অফ নেশনস। চলবে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর এবছর এই প্রতিযোগিতার মূল আয়োজক ক্যামারুন। এই আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টকে (Football Tournament) কেন্দ্র করেই ঐক্যের সুর বাজছে ক্যামারুনজুড়ে। ক্যামারুন সরকার এবং সরকার-বিরোধী গোষ্ঠী— ফুটবল মাদকতার জেরে উভয় পক্ষই এবার হাঁটল যুদ্ধবিরতির পথে।

কিন্তু এই জাতীয় দ্বন্দ্ব ও গৃহযুদ্ধের কারণ কী? সেই কারণ খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় একশো বছর। ১৯৮৪ সালে প্রথম জার্মানরা উপনিবেশ স্থাপন করে ক্যামারুনে। ১৯১৬ সালে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যামেরুনের দখল নেয় ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী। এই দুই ইউরোপিয় শক্তির মধ্যেই ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল ক্যামারুনের আধিপত্য। ক্যামারুনের ৮০ শতাংশ ভূখণ্ডের দাবিদার ছিল ফ্রান্স। বাকি ২০ শতাংশ ছিল ব্রিটিশদের দখলে। 

তবে মূল সমস্যা শুরু হয় স্বাধীনতার পর। ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা পায় ফ্রান্স-অধিকৃত ক্যামারুন। পরের বছর স্বাধীন হয় ব্রিটিশ উপনিবেশটি। সেই বছরই এক প্রশাসনের ছাতার তলায় আসে দুটি ভিন্ন অঞ্চল। দেখতে গেলে শিল্প-সংস্কৃতি পার্থক্য ছিল না কিছুই। তবে ঐক্যের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় ভাষা। কারণ দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে থাকার ফলে স্পষ্টতই ফরাসি ও ইংরাজিভাষী হয়ে উঠেছিল ক্যামারুনের দুই অংশ। বিবাদও সেই নিয়ে। তুলনামূলকভাবে ইংরাজিভাষী ক্যামারুনবাসীর সংখ্যা কম হওয়ায় তাঁদের যোগ্য মর্যাদা বা অধিকার প্রদান করা হয় না— এমন অভিযোগ ছিল দীর্ঘদিন ধরেই। বছর ছয়েক আগে সেই বিতর্কই রূপ নেয় গৃহযুদ্ধের। 

২০১৬ সালে সাবেক ‘ব্রিটিশ’ ক্যামারুনের আইনজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী মানুষেরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয় অসংখ্য মানুষকে। সেইসঙ্গে লাঠিচার্জ, জল কামান কিংবা রাবার বুলেটেরও অভাব ছিল না। একটানা এই অত্যাচারের পর, ক্যামারুনের পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যা চলছে এখনও। 

তবে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের কারণে দু’পক্ষই সাময়িকভাবে সায় দিয়েছে শান্তিচুক্তিতে। ‘ব্রিটিশ’ ক্যামারুনের অ্যাংলোফোন অঞ্চলের রাস্তায় নির্বিবাদেই টহল দিতে পারছে ক্যামারুনের জাতীয় বাহিনীর সেনারা। সেখানেই যে আয়োজিত হচ্ছে আফ্রিকান কাপ অফ নেশনস। অন্যদিকে অন্যদিকে বিভেদ ভুলে উভয় ভাষাভাষীর মানুষরা একইসঙ্গে আংশ নিচ্ছেন এই আয়োজনে। 

শুধু শান্তিই নয়, ফুটবলের এই পরিমণ্ডল যেন সাক্ষাৎ বর হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যামারুনের কাছে। আফ্রিকান কাপকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দাকেও কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন ক্যামারুনের ব্যবসায়ীরা। একটা সময় চিলি, উরুগুয়ে কিংবা আর্জেন্টিনার মতো লাতিন আমেরিকার দেশে প্রতিবাদ, বিপ্লবের ভাষা হয়ে উঠেছিল ফুটবল। এবার ক্যামারুনের রাজনৈতিক টালবাহানার মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনল ফুটবলের মাদকতা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More