এই প্রথম রক্তহীন অযোধ্যা, বুদ্ধ পূর্ণিমায় বন্ধ রইল ‘শিকার উৎসব’

'সেঁদ্রা' শব্দের অর্থ শিকার নয়, সান্তালি ভাষায় এই শব্দের অর্থ অনুসন্ধান। তবে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা অর্থাৎ বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে জঙ্গলমহলের মানুষ মেতে ওঠেন শিকার উৎসবে। উৎসবের নাম বীর দিশম সেঁদ্রা। এই উৎসবের ইতিহাস কতটা প্রাচীন, সেই সম্বন্ধে অবশ্য কিছুই জানা যায় না। তবে বোঝা যায়, তখন মানুষের জীবন ছিল সম্পূর্ণ অরণ্য নির্ভর। আর তাই খাদ্যের অনুসন্ধানে মানুষকে যেতে হত জঙ্গলে। ফলমূল এবং পশুপাখি শিকার করেই ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটত।

তবে কালক্রমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষকে এখন আর খাদ্যের জন্য জঙ্গলের উপর নির্ভর করে থাকতে হয় না। বরং জঙ্গলে শিকার উৎসব পরিণত হয়েছে এক ভয়ঙ্কর হত্যার উৎসবে। যেখানে মানুষের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে অসংখ্য পশুপাখি। তবে এর জন্য আদিবাসীদের সংস্কৃতিকে দায়ী করা চলে না। বরং শহরের সভ্য 'দিকু'রাই নির্বিচারে লুঠ করেছে জঙ্গল। কিন্তু তার সঙ্গেই যখন মিলে যায় আদিবাসীদের শিকার উৎসব, তখন অবস্থা রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।

অবশ্য জঙ্গলের মধ্যেই যাদের দীর্ঘদিনের বাস, সেই আদিবাসীদের একথা বুঝতে খুব বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়। বহুদিন ধরেই তাই এই হত্যালীলা বন্ধ করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে ‘ভারত জাকাত সাঁওতাল মাঝি পরগনা’ নামের সংগঠনটি। কিন্তু এর সঙ্গে যে দীর্ঘদিনের রীতিনীতি জড়িয়ে। তাই সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটা খুব একটা সহজ নয়। আর তার সঙ্গে শহর থেকে আসা শিকারী এবং পর্যটকদের প্রলোভন তো আছেই। শহরাঞ্চলের বহু মানুষ এই বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন তাঁদের শিকারের শখ মেটাতে জড়ো হয় অযোধ্যা পাহাড়ের আশেপাশের অরণ্য অঞ্চলে। তবে এবছর চেহারাটা যেন একটু অন্যরকম। এই প্রথম বুদ্ধ পূর্ণিমার দিনে এক ফোঁটা রক্ত ঝরল না অযোধ্যা পাহাড়ের উপকণ্ঠে। সাঁওতাল আদিবাসীদের গলায় এবছর অহিংসার সুর। আর সেই সুরের সঙ্গে সঙ্গত দিয়ে গিয়েছেন বনদপ্তরের কর্মীরাও।

পুরুলিয়ার ডেপুটি ফরেস্ট অফিসার রামপ্রসাদ বাদানা বলেন, লকডাউনের ফলে বাইরে থেকে পর্যটক আসতে পারেননি। আর বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের জন্য আদিবাসীদের মধ্যে তো প্রচার চলছিলই। আর এর ফলেই এবছর এই হত্যালীলা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।

স্থানীয় আদিবাসীদের কথায়, সকাল হতেই কয়েকজন অবশ্য তীর ধনুক নিয়ে তৈরি হয়ে পড়েছিল। তবে বাকিদের সমবেত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তারা আর জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পায়নি। তবে উৎসবের মেজাজে যাতে ছেদ না পড়ে, তাই জঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ চলেছে। কিন্তু কোনো প্রাণীর রক্তক্ষরণ ঘটেনি।

লকডাউনের কারণে অবশ্য শিকারের যথেষ্ট অনুকূল সুযোগ ছিল বলেই মনে করছেন আদিবাসীরা। প্রতিদিন জঙ্গলের বাইরে লোকালয়ের মধ্যেও ঘুরে বেড়াতে দেখা যাচ্ছে হায়না, শূকরের মতো প্রাণীদের। কিন্তু গ্রামবাসীরা সমবেতভাবে এই নৃশংস রীতি বন্ধ করতে পেরেছেন। আর তাঁদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করতে শহর থেকে কোনো শিকারসন্ধানী মানুষ এবছর সেখানে পৌঁছতে পারেননি লকডাউনের জন্যই। এভাবেই একটি দীর্ঘদিনের প্রথায় ছেদ পড়ল। সেইসঙ্গে অসংখ্য বন্যপ্রাণীর প্রাণ বেঁচে গেল।

পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গল মহলের এই শিকার উৎসব সারা দেশ জুড়েই বিখ্যাত। প্রতি বছর বহু শূকর, বনবেড়াল, বহু পাখি প্রাণ হারায় এই উৎসবে। বছর দুয়েক আগে ঝাড়খণ্ড থেকে ঢুকে পড়েছিল একটি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। শিকারীদের অস্ত্রের আঘাতে প্রাণ হারিয়েছিল সেই প্রাণীটি। সেবারেও সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছিল অযোধ্যা পাহাড়ের শিকার উৎসব। এবছর আবারও সেই উৎসব সংবাদের শিরোনামে। তবে এবারের কারণ সম্পূর্ণ অন্য। আর একবার যখন এই হত্যালীলা বন্ধ হয়েছে, তখন আর কখনই পাহাড়ের বুকে বন্য প্রাণীর রক্ত ঝরতে দেবেন না বলে দাবি করছেন গ্রামবাসীরা।