ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা প্রজাতির সাপ। কোনোটি ভয়ংকর বিষধর, আবার কোনোটি নির্বিষ। একেকটি আবার লম্বা, পেশিবহুল পাইথন। একটি দুটি নয়, সংখ্যায় অনেক। এমন একটি ঘরে পা দিতেও হাজার বার ভাবব আমরা। অথচ সেখানেই নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একজন সাধু। মুণ্ডিত মস্তক, গেরুয়া পরে সাপেদের মধ্যেই থিতু হয়েছেন। ওদের নিয়েই খেলছেন; সাপগুলোও ‘জড়িয়ে’ ধরছে তাঁকে। এতটুকুও ভয় করছে না? ভয় কেন করবে, ওরা তো আমার সন্তানের মতো! হ্যাঁ, এমনই কথা মায়ানমারের বৌদ্ধ সাধু উইলিথার…
মায়ানমারের ইয়াঙ্গনের সেইকতা থুখা তেতু মনাস্ট্রি। অন্যান্য বৌদ্ধ মঠের মতোই নিস্তব্ধ, সুন্দর একটি পরিবেশ। আর সেখানেই বসবাস সাধু উইলিথার এবং তাঁর ‘সন্তান’দের। পাইথন থেকে ভাইপার— প্রত্যেকের অবাধ জায়গা সেখানে। সবাইকে নিয়ে দিব্যি মেতে আছেন তিনি। তাও আজ থেকে নয়, বিগত পাঁচ বছর ধরে সাপের এমন ‘আড্ডাখানা’ জন্ম দিয়েছেন উইলিথা। পুরোটাই তাঁর মস্তিস্কপ্রসুত। কিন্তু এমন একটি কাজ করার ভাবনা এল কেন?
মায়ানমার-সহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক জায়গাতেই বিপুল জীববৈচিত্র্য দেখা যায়। আর তাদের মধ্যে সাপও অন্যতম। তবে বহু বছর ধরেই এই সরীসৃপদের জীবনে বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। সৌজন্যে, চোরাশিকার। বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাশিকারিরা সাপ ধরেন স্রেফ চামড়ার লোভে। ফলে বেঘোরে মারা পড়ে এরা। অবস্থা এমন হয়েছে যে, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে প্রবলভাবে। সাপের সংখ্যা কমছে, সেইসঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে অবৈধ পাচার। এই পুরো ঘটনাই দেখে আসছেন সাধু উইলিথা। বৌদ্ধ ভিক্ষু তিনি; প্রাণীহত্যা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। আর কেনই বা এই কাজ হচ্ছে? এর ফলে যে আমাদের চারিপাশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে সেটা কি কেউ দেখতে পাচ্ছে না?
এই চিন্তা থেকে বছর পাঁচেক আগে নিজেই উদ্যোগ নিলেন। ইয়াঙ্গনের সেইকতা থুখা মনাস্ট্রির ভেতরেই তৈরি করলেন সাপেদের আবাসস্থল। আশেপাশের জায়গা থেকে যেসব সাপেদের উদ্ধার করা হচ্ছে, তারা এসে ঠাই নিচ্ছে এখানে। এইভাবেই সাপেদের রক্ষা করেছেন চলেছেন উইলিথা। এরা যেন নিছক ঠান্ডা রক্তের সরীসৃপ নয়; তাঁর আপনজন। স্নেহের সঙ্গে এদের বড়ো করেন। তারপর সময় হলে ছেড়ে দিয়ে আসেন বনে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন প্রাণী সংরক্ষণ, এর নজিরও যে খুব একটা দেখা যায় না…
প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ— প্রত্যেকে জানেন উইলিথার কথা। জীব সংরক্ষণ নিয়ে যারা কাজ করেন, তাঁরাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন এই বৃদ্ধের দিকে। যখনই কোনো সাপ ধরা পড়ে, সবাই তাকে নিয়ে চলে আসেন ইয়াঙ্গনের এই মঠে। আদর করে বুকে টেনে নেন উইলিথা সাধু। লক্ষ্য একটাই, কালো দুনিয়ার হাত থেকে এদের বাঁচানো। তা না হলে যে পাচার হয়ে যাবে এরা, মরে যাবে। আমাদের অস্তিত্বও যে তাহলে সংকটে পড়বে…
Powered by Froala Editor