পাওয়ার আর্তি, বিচ্ছেদ, না-পাওয়া, হারানো : অন্য' প্রেম আর ৪টি গল্প

প্রেমের কি কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা হয়? আদৌ কি সরলরৈখিক এই অনুভূতি? প্রতিটা সম্পর্কেই তো কত ভাঙাগড়া, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি। পাওয়ার আনন্দের পাশাপাশি, জেগে থাকে না-পাওয়ার বেদনাও। সমপ্রেমেই বা ব্যতিক্রম হয় কী করে! চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে এই যে দুস্তর ফারাক, তা সমপ্রেম বা বিষমপ্রেমের ওপর নির্ভর করে না। একটি ছেলে যখন একটি ছেলেকে ভালোবেসে পেল না, কিংবা একটি মেয়ে আরেকটি মেয়েকে, তার ব্যথা আর পাঁচজনের থেকে আলাদা নয়। কিছু কিছু অনুভূতি শাশ্বত। কোনো কোনো লড়াইও। আর সেই অনুভূতি আর লড়াইয়ের কাহিনিই বুনেছেন চারজন পরিচালক, তাঁদের শর্ট ফিল্মে।

আরও পড়ুন
তোয়াক্কা করেননি সমাজের, কলকাতার বুকে অপর প্রেমের গল্প বুনে চলেছেন এঁরাই

২১ ও ২২ জানুয়ারি কলকাতার পিভিআর ডায়মন্ড প্লাজায় আয়োজিত হয়েছে ‘বেস্ট অফ কাশিশ’। কাশিশ ও প্রান্তকথার এই যৌথ উদ্যোগে দেখানো হয়েছে চারটি নির্বাচিত শর্ট ফিল্ম। যে শর্ট ফিল্মগুলিতে ফুটে উঠেছে সমপ্রেমের কথা। পাওয়ার আর্তি এবং না-পাওয়ার একাকিত্ব। আর তারপর?

সমাজ আজও ‘প্রান্তিক’ করে রেখে দিয়েছে সমপ্রেমীদের। সিনেমা এমনই এক মাধ্যম, যা সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে পারে তাঁদের সম্পর্কে। ‘বেস্ট অফ কাশিশ’-এর মিডিয়া পার্টনার ছিলাম আমরা, প্রহর.ইন। কী ছিল ওই চারটি শর্ট ফিল্ম? কেমন লাগল আমাদের? ধরার চেষ্টা করলাম এই লেখায় -

১। মাছের ঝোল (দ্য ফিশ কারি)

প্রিমিয়ারের চারটে শর্ট ফিল্মের একদম প্রথমটি ছিল ‘মাছের ঝোল’। অ্যানিমেশনের মোড়কে উঠে আসে একটি ছেলের গল্প। না, পুরো জীবনের গল্প দেখাননি পরিচালক অভিষেক ভার্মা। বরং তুলে এনেছেন একটি ছোট্ট মুহূর্ত, যেটা ছেলেটির জীবনকেই চিত্রায়িত করে।

গল্পটি এগোয় মাছের ঝোল বানানো নিয়ে। বাবা আসবে, সেজন্য বাজার থেকে মাছ কিনে নিজে রান্না করে ছেলেটি। ওঁর বন্ধু অফিসের কাজে বাইরে গেছে। ছেলেটির মধ্যে সেই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ও ঠিক আছে তো? কবে ফিরবে? ব্যাকগ্রাউন্ডেও বাজতে থাকে অপেক্ষার গান। এ কীসের অপেক্ষা? বন্ধুর জন্য স্রেফ উৎকণ্ঠা, নাকি নিজের ভালবাসার স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষা? ছেলেটি স্বপ্ন দেখে। মাছের ঝোলও সম্পূর্ণ হয়। নিজের সংসার গোছানোর চেষ্টায় রয়েছে সে। কিন্তু বাবা চান, যত শীঘ্র পাত্রী দেখে ছেলের বিয়ে হয়ে যাক।

কি করে বলবে বাবাকে? দোনামোনার মাঝে, খাওয়ার সময় সাহস করে বলেও দেয় সে। তারপর? এখানেই প্রশ্নচিহ্ন রেখে যান পরিচালক। জানা যায় না পরিণতি। ফাঁকা থালায় শুধু পড়ে থাকে মাছের উচ্ছিষ্ট, তার ওপর ঘুরপাক খায় মাছি। অ্যানিমেশনের ম্যাজিকে অত্যন্ত ছিমছামভাবেই ফুটে উঠেছে পুরো জিনিসটা। তাহলে কি সমস্ত কিছু অগোছালো হয়ে গেল? দর্শকদের ওপরেই এই বিচার ছেড়ে দিয়েছেন অভিষেক। কারণ এই গল্প তো আরও অনেকের গল্প। নিজের আসল কথাগুলো বলতে না পারার গল্প, সমাজের ভয়ে চুপ করে বসে যাওয়ার গল্প।

২। লাডলি

“দাদু বলত, বড় হয়ে আমি পরিবারের সম্মান রক্ষা করব। মাথা উঁচু করে বাঁচবে সবাই। আমিই সেটা করব”— নিজের নির্মীয়মাণ বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে এই কথাগুলো বলে লাডলি। বিহারের দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মেছিল সে। দিব্যি চলছিল সবকিছু। কিন্তু, শরীরে কিছুর যেন ‘অভাব’ ছিল। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। তারপরেই, ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ে সমস্তটা। তথাকথিত ‘নারী’ বা ‘মেয়েমানুষ’ বলতে লোকে যা বোঝে, এ ঠিক তেমন নয়। নারীসুলভ কোমলতা নেই তাঁর। সে নাকি ‘মেয়ে’ নয়।

পুরো সিনেমা জুড়ে লাডলির জীবন দেখিয়েছেন পরিচালক সুদীপ্ত কুণ্ডু। কোনও ক্যামেরার কারসাজি নয়, কোনও স্টুডিও সেট নয়। একদম বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে উঠে আসা গল্প। নিজের পরিবার থেকেও ভালবাসা পায়নি লাডলি। কারণ? সে যে আর পাঁচটা ‘মেয়ে’র মতো নয়! শুধু কি লাডলিরই জীবন? আমাদের ভারতের একটা বড় অংশের ছবিই কি উঠে এল না ছবিতে? দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়ার পর ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি বাড়ি কাজ করেছে, পরে বাধ্য হয়ে দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তাঁর বড় টাকার দরকার। টাকা ছাড়া আর যে কেউ কিছু বোঝে না! নিজের মা-কেই এমন দেখেছে লাডলি। 

আরও পড়ুন
অন্য প্রেমের গল্প ফুটে উঠবে পর্দায়, ‘কাশিশ’ ও ‘প্রান্তকথা’র ছকভাঙা আয়োজন কলকাতায়

শর্ট ফিল্ম না বলে একে ডকুমেন্টারি বললে অত্যুক্তি হয় না। সংসার, প্রেম, জীবন, পরিবার— সমস্ত কিছু ঘুরে ঘুরে ক্যামেরাবন্দি করেছেন পরিচালক। তবে দৈর্ঘ্য বেশ খানিকটা বেশি অন্যান্য ছবির তুলনায়। সিনেমাটি শেষ হয় লাডলির ভালবাসা দিয়ে। সমস্ত কিছু জানা সত্ত্বেও হিন্দু ঘরের একটি ছেলে তাঁকে ভালবেসেছে। বিয়ে করতে চায়। ভালবাসার কাছে যে ধর্ম, শরীর সব তুচ্ছ! লাডলি এখন তারই স্বপ্ন দেখছে…   

৩। ইউ ফর ঊষা

মাত্র কয়েক বছর আগেও সমকামীতা যে দেশে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ ছিল, সেদেশের আনাচে কানাচে এখনও বহু মানুষের নিরুচ্চার আকাঙ্খা প্রতিমুহূর্তে বিষমকামী সম্পর্কের কাছে মার খাচ্ছে। তেমনই এক সমকামী মহিলার গল্প ইউ ফর ঊষা। মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বিধবা ঊষা। ক্ষেতের কাজ করে তার সন্তানদের মানুষ করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও তার জীবনে এক অন্য লড়াই আছে।

নিজের 'ব্যতিক্রমী' পরিচয় প্রকাশ করতে যেটুকু সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন, তার সিকিভাগও নেই ঊষার। বাইশ মিনিটের এই শর্টফিল্মে দেখতে পাই নিজের পরিচিতি গোপন রেখে অর্থের জন্য বিষমকামী  যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হতে হচ্ছে ঊষাকে। তবে এই সিনেমায় 'স্বাভাবিক' আর 'ব্যতিক্রমে'র লড়াইয়ের থেকেও বড় হয়ে ওঠে একটি প্রেমের অনুভূতি। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা মনীষার প্রতি ঊষার আকর্ষণ ক্রমশ ভিন্ন সামাজিক চেহারা নেয়। মনীষার হাত ধরে নিরক্ষর ঊষা ধীরে ধীরে পড়াশুনো শুরু করে। তাকে আর টিপছাপ দিয়ে মজুরি নিতে হয় না। ক্ষেতের অন্যান্য কর্মচারীদের থেকে এখানেও তো সে 'ব্যতিক্রম'।

নিজের 'ব্যতিক্রমী' পরিচয়কে মেনে নিতে কোন দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়নি ঊষার জীবনে। তেমনি সেই পরিচয়ের প্রকাশও ঘটেনি কোথাও। প্রতিদিনের পরিচিত বিষমকামী প্রেমের গল্পগুলোর বাইরে গিয়ে এক অনন্য সুন্দর গল্প উপহার দিলেন পরিচালক রোহণ পরশুরাম কানওয়াডে।

৪। আ মনসুন ডেট

আকাশ ভেঙে পড়ছে বৃষ্টি। তার মধ্যে এক নিঃসঙ্গ যুবতী চলেছে তার জীবনসঙ্গীর সন্ধানে। পনেরো বছর না কুড়ি বছর, হিসাব নেই। কিন্তু একদিন সে নিশ্চই খুঁজে পাবে তার জীবনসঙ্গীকে। এই গল্পে আপাত কোনো নতুনত্ব নেই। যদি না আমরা জানি এই যুবতীর যুবতী হয়ে ওঠার ইতিহাস। সেই ছোটোবেলায় তার পুরুষ সহপাঠীকে দেখে সম্পর্কের প্রথম অনুভূতি। তারপর নিজের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। তারপর জড়িয়ে পড়া একটি বৃহন্নলা সমাজের সঙ্গে। তারপর শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে সার্বিক রূপান্তর। এভাবেই দীর্ঘপথ অতিক্রম করে যুবতী হয়ে উঠেছে সে।

সবথেকে মন ছুঁয়ে যায়, যখন দেখি রূপান্তরকামী মানুষের গল্পগুলো সমাজে প্রতিনিয়ত যেভাবে মার খাচ্ছে, তেমনই নিরুচ্চার থেকে যায় এই সিনেমাতেও। সারাদিন ব্যস্ত শহরের বুকে কতকিছু ঘটে। কত সম্পর্কের ভাঙাগড়ার সাক্ষী থাকে শহর। কিন্তু রূপান্তরকামীদের জীবনের লড়াই এইসবকিছু ছাপিয়ে নিজের আত্মসম্মানের অধিকার। দীর্ঘ পথচলার পরেও নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে পায়নি সে। যখনই কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভবনা এসেছে, বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার রূপান্তরকামী পরিচিতি। তার পরিচয় শুনে কেউ বমি করে ফেলেছে, কারোর চোখ ঘেন্নায় ছোট হয়ে এসেছে। 

কিন্তু এবার যেন ঠিক আগের মতো নয়। ছেলেটির চোখে কোন ঘেন্না নেই, কোনো অপমান নেই, শুধু কথা মতো নিঃশব্দে উঠে চলে গেছে। বৃষ্টির মধ্যে সেই চলে যাওয়ার দৃশ্য দিয়েই সিনেমা শেষ হয়ে যায়। জানা হয়ে ওঠে না, তার জীবনসঙ্গীকে সে খুঁজে পেল কিনা। শুধু জানি, একদিন না একদিন সে খুঁজে পাবে। তনুজা চন্দ্রার পরিচালনায় কঙ্কনা সেনশর্মার অনবদ্য অভিনয়ে যে-কোনো মানুষের মন ছুঁয়ে যেতে পারে 'আ মনসুন ডেট'।

More From Author See More