চলতি বছর পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন যেসব বাঙালি

১৯৫৪ সাল থেকে প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন প্রদান করা হয় পদ্ম পুরস্কার। নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দেশকে সম্মানিত করেছেন, রাষ্ট্রের তরফ থেকে তাদেরকেই সম্মানিত করা হয় এইদিন। এবছর ১৪১ জন ব্যক্তিকে প্রদান করা হচ্ছে ত্রিস্তরীয় পদ্মপুরস্কার। ১৮৮ জন পাচ্ছেন পদ্মশ্রী, ১৬ জন পদ্মভূষণ এবং সাতজন পদ্মবিভূষণ। আর পুরস্কারজয়ীদের মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ৬। প্রতিবছরের মতো এবছরও বাঙালির জাত্যাভিমানকে উস্কে দিয়ে গেল পদ্ম পুরস্কার। একনজরে দেখে নেওয়া যাক, কোন কোন বাঙালি পুরস্কার পেলেন এবার -

অজয় চক্রবর্তী

এবছর পদ্মভূষণ পুরস্কার পাচ্ছেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষকতায় দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন তিনি। পেয়েছেন সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, মহাসঙ্গীত সম্মান, বঙ্গভূষণ'-এর মতো একাধিক সম্মাননা। ২০১১ সালে পেয়েছিলেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। ১৯৫২ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী। শিক্ষালাভ করেছেন মুনাওয়ারা আলি খান, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের মতো দিকপালদের থেকে। পাতিয়ালাকাসুর ঘরানায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা থাকলেও, গেয়েছেন বহু অন্য ধারার গান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানির মতো নানা দেশ থেকে তাঁর অ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে। তবে সঙ্গীতশিল্পী অপেক্ষা সঙ্গীতশিক্ষক হিসাবেই মূলত পরিচিত তিনি। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'শ্রুতিনন্দন' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষকতার পাশাপাশি সঙ্গীত বিষয়ক গবেষণার কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান।

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি

২০১৯ এর ৩০ ডিসেম্বর মারা যান সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলি। এবছর তাঁকে মরণোত্তর পদ্মভূষণ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। ১৯৪৪ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ভারতবর্ষের বাংলাদেশ দূতাবাসে বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করার ক্ষেত্রেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল।

মণিলাল নাগ

ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিষ্ণুপুর ঘরানার বিখ্যাত সেতারবাদক মণিলাল নাগ। ১৯৫৩ সালে প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ করেন। দেশবিদেশের নানা অনুষ্ঠানে সেতার পরিবেশন করেছেন। ১৯৫৪ সাল থেকে আকাশবাণীর সঙ্গীতানুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। ১৯৭৩ সালে আইসিসিআর কর্তৃক দেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালে ভারত মহাসাগর আর্ট ফেস্টিভ্যালে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটিসহ ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে পেয়েছেন সিনিওর ফেলোশিপ পুরস্কার, সঙ্গীত মহাসম্মান পুরস্কার, বঙ্গভূষণ পুরস্কার। এবছর পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন মনিলাল নাগ।

অরুণোদয় মণ্ডল

বিরাটির অরুণোদয় মণ্ডল। এবছরের পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় উজ্জ্বল এই বাঙালি চিকিৎসকের নাম। পেশাদার চিকিৎসকের পাশাপাশি তাঁর অন্য পরিচয়, তিনি সুন্দরবনের 'সুজন'। সাহেবখালি গ্রামপঞ্চায়েতের দায়পাড়া গ্রামে তৈরি করেছেন 'সুজন চিকিৎসা কেন্দ্র'। দীর্ঘদিন ধরে প্রতি সপ্তাহের শেষে তিনি উপস্থিত হন সেখানে। শনিবার সকালে হাসনাবাদ লোকালে পৌঁছন হাসনাবাদ। সেখান থেকে রিকশায় নদীঘাট। নদীপার হয়ে বাস, তারপর আবার নৌকো। আর এই দীর্ঘ যাত্রার শেষে তাঁর জন্য অপেক্ষা করেন শয়ে শয়ে মানুষ। বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন গ্রামবাসীদের। সুন্দরবনের দরিদ্র্য গ্রামবাসীদের প্রিয় সুজন এবারে পদ্ম পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় বিশেষ আলোচনার ব্যক্তি।

সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়

সুশোভনবাবু বীরভূমের 'একটাকার ডাক্তার'। সেই ষাটের দশকে চিকিৎসা শুরু করেন সুশোভনবাবু। তখন তাঁর ফি ছিল এক টাকা। তারপর জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও নিজের ফি আর বাড়াননি তিনি। তাই 'একটাকার ডাক্তার' বলতেই সবাই একডাকে চেনে তাঁকে। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির চিকিৎসা করেছেন তিনি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক ডাক্তার ছিলেন। চিকিৎসার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। একসময় বোলপুর লোকসভা থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির সদস্য তিনি। এবছর কেন্দ্র সরকারের থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন ডাক্তার সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়।

কাজী মাসুম আখতার

যাদবপুর কাটজুনগর স্বর্ণময়ী বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসুম আখতার। এবারের শিক্ষা ও সাহিত্য বিভাগে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন তিনি। ইসলাম ধর্মের সংকীর্ণতা ও মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে চিরকাল বিরোধ এই মানুষটির। প্রতিবাদ করেছেন বাল্যবিবাহ, তিন তালাকের মতো প্রথাগুলির। ২০১৫ সালে একটি মাদ্রাসায় ছাত্রদের দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইয়ে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন তিনি। তিন তালাকের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন। চিরকাল ধর্মের উর্ধ্বে মানবতার পক্ষে থাকা এই মানুষটির স্বীকৃতিতে খুশি ছাত্রছাত্রী থেকে সহকর্মী সকলেই।