বিদ্রোহী সিপাহীদের অবমাননা, বঙ্গসন্তানের উদ্যোগে বদলাচ্ছে এডিনবার্গ দুর্গের ফলক

স্কটল্যান্ডের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র এডিনবার্গ দুর্গ। বছরের পর বছর ধরে ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই স্থাপত্য। সম্প্রতি সেখানে হাজির হয়েছিলেন স্কটল্যান্ড নিবাসী ভারতীয় বংশোদ্ভূত চিকিৎসক বিবেক মজুমদার। দুর্গপ্রাঙ্গণে ঘুরতে ঘুরতেই দৃষ্টি আটকে যায় একটি স্মৃতিফলকে। চোখে পড়ে একটি অসঙ্গতি। একপেশে দৃষ্টিকোণে সেখানে ছোটো করা হয়েছে ভারতীয়দের। কিন্তু কী ছিল সেই ফলকে লেখা?

১৮৫৭ সাল। ভারতে তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বয়স হয়েছে ১০০ বছর। তবে সে বছর সারা ভারতের সিপাহীরাই একত্রিত হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে। গড়ে তুলেছিল মিউটিনি— সিপাহী বিদ্রোহ। যার আঁচ থেকে বাদ পড়েনি লখনউ-ও। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ১ লক্ষ সৈনিক অংশ নিয়েছিল সেই বিদ্রোহে। আর ফলাফল?

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কমিশনার হেনরি লরেন্স আন্দোলন ঠেকাতে শেষ অবধি পাঠিয়েছিলেন গোরা সৈনিকদের। লখনউয়ের ক্ষমতা ফেরাতে সেদিন কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন স্কটিশ জেনারেল কলিন ক্যাম্পবেল। তাঁর নেতৃত্বেই দমন করা হয়েছিল লখনউয়ের বিদ্রোহ। বলাই বাহুল্য তাতে প্রাণ গিয়েছিল বহু ভারতীয় সৈনিকের। 

তবে এই বিজয়ের স্মারক হিসাবেই এডিনবার্গ দুর্গে তৈরি হয়েছিল ‘ইন্ডিয়া ক্রস’। বসেছিল স্মৃতিফলক। দেড়শো বছর পেরিয়ে আসার পরে সেই অপরিবর্তিত ফলকই চোখে পড়েছিল বাঙালি চিকিৎসক বিবেক মজুমদারের। তবে সেই ফলকে ব্রিটিশদের জয় এবং বীরত্বের জয়গানই বিব্রত করে তুলেছিল বঙ্গতনয়কে। বার বার ফিরে আসছিল ফলকে লেখা কথাগুলো। ‘ভারতীয় সিপাহীদের থেকে লখনউ মুক্ত করেন স্কটিশ সৈন্যরা’। সত্যিই কি তাঁরা ‘মুক্ত’ করেছিলেন লখনউকে? 

সিপাহী বিদ্রোহ যেখানে ঔপনিবেশিক শাসন ভেঙে স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন বলে বিবেচিত হয়, সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘিরেই এমন মন্তব্য? বিকৃত এই ইতিহাসকে মেনে নিতে পারেননি বিবেক। বরং চিঠি পাঠিয়েছিলেন দুর্গ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাকে। ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ জানিয়েই তিনি আবেদন করেন প্রকৃত ইতিহাসকে মর্যাদা দিয়ে ফলকটি পরিবর্তন করার জন্য।

এক সপ্তাহের মধ্যেও প্রত্যুত্তর আসে। স্কটল্যান্ড প্রশাসন আশ্বাসও দেয় আসল ঘটনার প্রেক্ষিতেই ভারতীয় সৈনিকদের ন্যায্য মর্যাদা এবং বীরত্বের কথাই লেখা হবে নতুন ফলকে। 

আরও পড়ুন
হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই; বাংলার দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলনেই জন্ম পুরুলিয়ার

ঔপনিবেশিক রাজত্বের মহিমাপ্রদর্শন একপ্রকার সাম্রাজ্যবাদকেই চিহ্নিত করে বলেই মনে করছেন বিবেক মজুমদার। যা এক প্রকার পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ভুল বার্তাই। নিজের দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য প্রাণ দেওয়া সিপাহীদের ন্যূনতম সম্মানটুকুও দেওয়া হচ্ছে না সেখানে। সে জন্যই এই পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানান তিনি। এত বছর ধরেই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল বিকৃত ইতিহাসের স্মারকটি। চিকিৎসক বিবেক মজুমদারের আগে যে কোনো ঐতিহাসিক কিংবা নিদেনপক্ষে ভারতীয় পর্যটকও যাননি ওই দুর্গে, এমনটা নয়। তবে সকলের চোখই এড়িয়ে গিয়েছিল হয়তো। কিংবা মুখ বুজেই সহ্য করে নিয়েছিলেন তাঁরা। শেষ অবধি বঙ্গতনয়ের উদ্যোগেই শুধরোতে চলেছে সেই ঐতিয়াসিক বিকৃতি...

Powered by Froala Editor