কাজ পাননি বাংলায়, মুম্বাই-এ প্রতিষ্ঠা পেয়েও নিজের শিকড়েই বুঁদ শিল্পী অনিকেত মিত্র

“আমার তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। আইটি সেক্টরের অত বড়ো চাকরি ছেড়ে দিলাম। এদিকে টলিউড পাড়ায় বারবার ঘুরেও কোনো সিনেমার কাজ পাচ্ছি না। ঠিক সেইসময় ঠিক সেইসময় ফোন এল মুম্বাই থেকে। মুকেশ ছাবরা তাঁর ছবি ‘কিজি অউর ম্যানি’-র স্টরিবোর্ড তৈরির জন্য আমাকে ডেকেছেন। মুম্বাই শহরে গিয়ে কোথায় থাকব জানি না। ঠিক করেছিলাম এয়ারপোর্টেই সমস্ত জিনিস রেখে আবার পরেরদিন ফিরে আসব। কিন্তু তখনই একজন ফেসবুক ফ্রেন্ডের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সে তার মুম্বাইয়ের বাড়ি ছেড়ে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় আসছে। আমি কোনোরকমে তাকে অনুরোধ করলাম, আমাকে যেন কিছুদিন তার বাড়িতে থাকতে দেয়। সেও রাজি হয়ে গেল। আর আমার কাজও পছন্দ হল মুকেশ ছাবরার। চিত্রনাট্য নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চলতে লাগল। পরে অবশ্য সিনেমার নাম বদলে গিয়ে হল, ‘দিল বেচারা’।”

বলছিলেন অনিকেত মিত্র। এখন অবশ্য সেই মুম্বাই শহরই তাঁর ঠিকানা। তবু তিনি মনেপ্রাণে বাঙালি। তাঁর সমস্ত ছবিতেই ফুটে ওঠে বাঙালিয়ানার ছাপ। অবশ্য বলিউডের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক নতুন নয়। বলিউডের শুরু থেকেই সঙ্গীত, অভিনয়, পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই বারবার বাজিমাত করেছেন বাঙালিরা। যদিও ভারতীয় সিনেমায় ‘ভিজুয়াল আর্ট’-এর চর্চা খুব পুরনো নয়। “তবে বাঙালি শিল্পীদের কাজ মুম্বাইতে বরাবরই খুব সমাদৃত। বাঙালি প্রোডাকশন ডিজাইনাররাও বরাবর এখানে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।” অনিকেত মিত্র আরও বলছিলেন, “বাঙালিদের একটা রুচিশীল শিল্পবোধ আছে, সেকথা সবাই আলোচনা করেন।” ফলে বাঙালি হিসাবে সেখানে জায়গা করে নিতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি।

কলকাতার আর্ট কলেজ থেকে গ্রাফিক ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করেন অনিকেত মিত্র। তার পরেই যোগ দিলেন কলকাতারই একটি আইটি কোম্পানিতে। কিন্তু সিনেমার প্রতি ভালোলাগাটা থেকেই গিয়েছিল। নব্বইয়ের কলকাতায় বড়ো হয়ে উঠেছেন অনিকেত মিত্র। তখন কলকাতায় চ্যাপলিন, যমুনা, প্যারাডাইস প্রভৃতি সিনেমা হলে নিয়মিত বিদেশি সিনেমা আসত। বাবার হাত ধরে সেইসব সিনেমা দেখতে যেতেন অনিকেত। আর এভাবেই গড়ে ওঠে এক ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার জোরেই একদিন আইটি কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিলেন। তখন তিনি একটি মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির ভিজুয়াল ডিজাইনারের কাজ করেন।

“২০১৪ সাল। মনে হল অনেক গল্প জমে আছে। সেই গল্প শোনানোর তাগিদ থেকেই হাত দিলাম একটি সিনেমার কাজে। আমার সেই সিনেমা জিও-মামি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মনোনীতও হল। তার জন্য একটা ছোটখাটো পরীক্ষা দিতে যেতে হয় মুম্বাই। আর সেখানেই আলাপ হয় পরিচালক মুকেশ ছাবরার সঙ্গে।” তার পরের ঘটনা আগেই বলেছেন। জিও-মামি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়েছিল অনিকেত মিত্রের পরবর্তী শর্ট-ফিল্ম ‘আতর’-এর স্টোরিবোর্ডও। ২০১৭ সালে তৈরি হয়েছে সেই শর্ট-ফিল্মও। ‘দিল বেচারা’-র পর শুরু করলেন ‘পৃথ্বীরাজ’ সিনেমার কাজ। আর এরপরেই আলাপ হল অ্যাকশন ডিরেক্টর শ্যাম কৌশলের সঙ্গে। তিনিই আরও দুটি কাজের প্রস্তাব দিলেন। প্রথমটি মামুট্টি অভিনীত মালয়লম ছবি 'মামাঙ্গম'। দ্বিতীয়টি, মণি রত্নমের 'পনিয়ন সেলভান'। এরপর রণবীর সিং-এর 'জয়েশভাই জোরদার' সিনেমার অ্যাকশন সিক্যোয়েন্সের স্টোরিবোর্ডও করেছেন। এছাড়া আছে হাউসফুল ফোর, মামাঙ্গাম। এই বছর দুয়েকের মধ্যেই তালিকাটা বেশ লম্বা।

সিনেমার জন্য স্টোরিবোর্ড যেমন এঁকে চলেছেন, তেমনই সাময়িক নানা ঘটনাকেও বারবার তুলে এনেছেন রঙে-রেখায়। “তবে এক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণা পেয়েছি সুকুমার রায়ের থেকে। সিনেমার কাজের অনুপ্রেরণা যেখানে সত্যজিৎ রায়। ওঁর লেখায় বারবার স্টোরিবোর্ডের কথা পড়েছি। নানা লেখার সঙ্গে ইলাস্ট্রেশনগুলো দেখে ছোট থেকেই মুগ্ধ হতাম। ঠিক একটা সিনেমার দৃশ্যকেই ফুটিয়ে তুলতেন সেখানে। আর একজনের প্রভাব খুব বেশি করে পড়েছে আমার ছবি আঁকার ধরনে। তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” বলছিলেন অনিকেত মিত্র। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আঁকায় বারবার ফুটে উঠেছে বাঙালিয়ানা। তাঁর কথায়, “আজকাল বাঙালি শিল্পীরা অনেক ভালো ভালো কাজ করছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার মধ্যে বিদেশি ছাপ স্পষ্ট। সেটাকে খারাপ বলছি না। কিন্তু আমি সবসময় বাঙালিয়ানাকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।”

তবু মনেপ্রাণে বাঙালি এই মানুষটা বাংলায় জায়গা পেলেন না। প্রতিষ্ঠা পেতে হতে হল মুম্বাই-প্রবাসী। আজও সেটা একটা গোপন দুঃখের মতো মনের মধ্যে বেঁধে। বাংলায় শিল্পচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়েও যথেষ্ট চিন্তিত তিনি। বলছিলেন, “প্রকাশকরা শিল্পীদের উপযুক্ত গুরুত্ব দেন না। শিল্পীরা উপযুক্ত পারিশ্রমিক দূরের কথা, উপযুক্ত সময়ও পায় না। আর বাংলা সিনেমার যা বাজেট, তাতে একজন স্টোরিবোর্ড আর্টিস্টকে কাজ দেওয়া তো সহজ নয়। অবশ্য এখন সৃজিত মুখার্জি, পাভেলের মতো পরিচালক অন্যধরনের কাজ করছেন। তবে বাজেট তো খুবই কম। এই অর্থনৈতিক অবস্থায় এক্সপিরিমেন্টাল কাজ হওয়া অসম্ভব। বাঙালি শিল্পীদের ছবিতেও তাই একটা একঘেয়েমি এসে যাচ্ছে।” তবু একদিন অবস্থা বদলাবে, আশা রাখেন অনিকেত মিত্র। উপযুক্ত পরিকাঠামো পেলে বাঙালিরাই যে বাজিমাত করেছে বারবার, তার উদাহরণ যে তিনি নিজেই!

Powered by Froala Editor

More From Author See More