বিশ্বযুদ্ধ, করোনা থেকে 'মানি হাইস্ট' - বেলা চাও-এর সুরে বারবার মজেছে ইউরোপ

গতবছরের কথা কথা। মধ্যপ্রাচ্যের রাস্তায় জড়ো হয়েছেন একদল প্রতিবাদী জনতা। তাঁদের প্রত্যেকের শরীরে লাল রঙের জাম্পিং স্যুট। মুখে দালি মাস্ক। এবং প্রত্যেকের মুখে একটি ইতালীয় গান। 'বেলা চাও'। দেখতে দেখতে পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠল এই গানটি। কিন্তু কোথায় উৎস এই গানের? আর তার সঙ্গে লাল স্যুট এবং দালি মাস্কের সম্পর্কই বা কী?

এই যোগসূত্র তৈরি করেছে একটি টিভি সিরিজ। যার নাম 'মানি হাইস্ট' (২০১৭-)। স্পেনের এই ধারাবাহিকটি ক্রমশ সারা পৃথিবীতেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর সেখানে প্রোটাগনিস্টের মুখে বারবার শোনা যায় এই গান। গানটির উৎসের কথাও সেখানে জানিয়েছেন তিনি। তাঁর অধ্যাপক এই গান শিখেছিলেন তাঁর ঠাকুরদার কাছে। আর সেই ঠাকুরদা ছিলেন ইতালির ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের একজন কর্মী। সেখান থেকেই শিখেছিলেন এই গান। ফ্যাসিবাদ বিরোধী মানুষের মন্ত্র, 'বেলা চাও'। দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যা প্রতিটি মানুষের প্রতিবাদের হাতিয়ার। সিরিজটির সাম্প্রতিকতম সিজন মুক্তি পেল আজ।

'মানি হাইস্ট'-এর এই সংলাপ থেকেই বোঝা যায়, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ইতালিতে যে গৃহযুদ্ধ চলে, সেই সময় এই গানের প্রসার। ফ্যাসি-নাৎসি আঁতাতের বিরুদ্ধে তথা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে থাকা মানুষের মন্ত্র ছিল এই গান। তবে তার ইতিহাস কিন্তু আরও খানিকটা পুরনো। সঠিক সময়কাল বা রচয়িতার নাম জানা যায় না। তবে ইতালির এই লোকসঙ্গীতটি উনিশ শতকের শেষ দিকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। চাষের ক্ষেতের মহিলা শ্রমিকদের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল 'বেলা চাও' বা 'হে সুন্দর, বিদায়'। বিশ শতকের উত্তাল রাজনীতির মঞ্চে নতুন রূপে হাজির হয়েছিল সেই একই মন্ত্র। মূল গানের কথায় সামান্য কিছু পরিবর্তন আসে, তবে সুর অপরিবর্তিত থাকে। আর অপরিবর্তিত থাকে উন্মাদনা।

চল্লিশের দশকের বহু পরেও ইতালির এই লোকসঙ্গীতটির জনপ্রিয়তা কিন্তু কিছুমাত্র কমেনি। এই গানের কথা, সুর অনুপ্রাণিত করেছে পরবর্তী বহু শিল্পীকে। ইতালির এক লোকসঙ্গীতশিল্পী জিওভানা দাফিনি তো রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন এই গানটির জন্য। এমনকি কিছুদিন আগে বলিউডের বেসরম সিনেমার একটি গানে এই সুর ব্যবহার করা নিয়ে বিতর্কও শুরু হয়।

তবে প্রতিবাদী মানুষ যেমন আপন করে নিয়েছেন এই গানকে, তেমনই চক্ষুশূল হয়েছে শাসকের। পঞ্চাশের দশকের একটু ঘটনায় সেই প্রমাণ পাওয়া যায়। রোমের শিক্ষা সচিবের আমন্ত্রণে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় প্র্যাটি শহরে। উদ্বোধনী সঙ্গীতের ভার পড়ে স্থানীয় একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক শিক্ষিকার উপর। তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন এই 'বেলা চাও' গানটি। শুনে সচিব এতটাই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে চূড়ান্ত অপমান করা হয় শিক্ষকদের। সেইসঙ্গে স্কুলের সংসাপত্রও বাতিল করা হয়।

তবে, সময় পেরিয়ে যায়। বদলায় সবকিছু। শুধু শোষণ আর বঞ্চনার সমীকরণটা বদলায় না। আর সেই কারণেই বদলায় না প্রতিবাদের মন্ত্র। সেই উনিশ শতকের গানটি আজও রাজপথে ঝড় তোলে। গলা মিলিয়ে একসুরে গেয়ে ওঠে সমস্ত প্রতিবাদী মানুষ। 'বেলা চাও চাও চাও'।

Powered by Froala Editor

More From Author See More