জাপানি কলাগাছ থুড়ি মহাকবি ‘বাশো’-র গপ্পো

পুরোনো পুকুর,
ব্যাঙের লাফ
জলের শব্দ।
(‘বাশো’ রচিত ‘হাইকু’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদ)

‘বাশো’ শব্দের অর্থ কলাগাছ। আবার বাশো একজন কবি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, 'এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়...।' শব্দ বুলিয়ে ছবি আঁকার অন্য নাম ‘হাইকু’। আর ‘হাইকু’ বলতেই তাঁর নামটাই সর্বপ্রথম মাথায় আসে - মাৎসুয়ো বাশো।

তাঁর প্রথম-জীবন সম্পর্কে এখনও নানা গালগল্প শোনা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর সামন্তশাসনাধীন জাপানের ‘ইগা’ রাজ্যের মানুষ তিনি। ‘ইগা’ ছিল গুপ্তঘাতক ‘নিনজা’-দের আঁতুরঘর। অনেকেই মনে করেন, প্রথম জীবনে বাশো-ও গুপ্তচরবৃত্তি করতেন ছদ্মবেশে। বাকিদের মতে, তিনি ছিলেন এক ‘সামুরাই’ যোদ্ধার রসুইকার। প্রভু ‘য়োশিতোরা তোদো'ও ছিলেন উদীয়মান কবি। ভৃত্যের সঙ্গে জোট বেঁধে লিখেছেন অজস্র ‘রেনকু’। ‘বাশো’ তখনও ওই নামে পরিচিত নন। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘সোবো’।

জাপানি কবিতার আদিরূপ হল ঐ ‘রেনকু’ বা ‘হাইকাই গা রেঙ্গা’। ‘রেনকু’-র প্রথম তিনটি পংক্তি ৫-৭-৫ মাত্রায় বিভক্ত। একে বলা হত ‘হোককু’। এই ‘হোককু’-ই পরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘হাইকু’ নামে।

‘বাশো’ খ্যাতি পেয়েছিলেন জীবনের মধ্যাহ্নে। টোকিও শহরের পুরোনো নাম ‘এদো’। কিওতোর পর জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে কবিমহলে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর কথা। তাঁর হাত ধরেই প্রচলন হয় ‘অণুকবিতার’। কিন্তু, জীবনপুরের পথিককে বেঁধে রাখা দায়। খ্যাতির দুনিয়া ছেড়ে তিনি সরে আসেন লোকচক্ষুর আড়ালে। প্ৰিয় শিষ্যরা কলাগাছ বেঁধে নির্মাণ করেছিল পর্ণকুটির। সেই থেকে তাঁর নাম ‘বাশো’।

年暮ぬ
笠きて草鞋
はきながら
(বছর এল ঘুরে,/ মাথায় ভবঘুরের ছাতা,/ বিচালির জুতো পায়ে)

এদোর পাকদণ্ডি পথ বেঁকেছে ফুজিয়ামা পাহাড়। খ্যাতি, প্রতিপত্তির ধার না ধেরেই মাটির টানে বারবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন কাঙাল কবি। মাঝেমধ্যে শিষ্যদের সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন আখড়া। ক্ষণস্থায়ী। গ্রহণ করেছেন জেন-বৌদ্ধধর্ম। ক্রমশ আরো নিভৃতে, কলাপাতায় ছোট্ট কুটিরে, জীবনের শেষ ক’টি বছর কাটিয়েছিলেন। সন্তানাদির খবর পাওয়া যায় না। কারো মতে, তিনি সমকামী। কিন্তু, সঙ্গিনী ছিলেন ‘জুতেই’ নামের এক ‘মিকো’। ‘মিকো’ শব্দের বাংলা অর্থ পূজারিণী। কবিরা নাকি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হন। জীবনের নৌকো বাইতে বাইতেই সম্ভাব্য মৃত্যুর ছবি দেখে বাশো লিখেছিলেন,

旅に病んで
夢は枯野を
かけ廻る
(অসুখ যাত্রাপথে/ স্বপ্ন চড়ে বেড়ায়,/ শুকনো ঘেসোমাঠে)

বাশো-র মতো করে জাপানের প্রকৃতিকে ছুঁতে হয়ত কেউই পারেনি। হাইকু আর বাশো সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন একসময়। যে হাইকুর ছন্দে মুগ্ধ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। অনুবাদও করেছিলেন বাংলায়। বাংলার এক মহাকবির ভাষা ছুঁয়েছিল জাপানি মহাকবির ভাষাকে।

আর বাশো? চিলের ডাকে, পুরনো আলপথের মাঝে, সদ্য শিশিরস্নাত কলাপাতায় লুকিয়ে রয়েছে তাঁর অনন্য ফকিরি দর্শন। খ্যাপা যে খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর। যুগযুগান্তরে...

(বাশোর ‘হাইকু’-র গদ্যানুবাদ লেখকের)