৪ হাজার বছর ধরে জ্বলছে আজারবাইজানের অগ্নিকুণ্ড!

ত্রয়োদশ শতাব্দীর কথা। ভেনিস থেকে এশিয়ার উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন ইতালিয়ান পর্যটক মার্কো পোলো। পুরনো সিল্ক রুট ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসেই চমকে উঠলেন তিনি। বলতে গেলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলেন। কনকনে ঠান্ডা। আকাশ থেকে খসে পড়ছে তুষারের ছোটো ছোটো টুকরো। কিন্তু মাটি স্পর্শ করার আগেই গলে যাচ্ছে তারা। কারণ ধূধূ এই প্রান্তরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বলছে আগুন। আর তার শিখা এঁকেবেঁকে পৌঁছে যেতে চাইছে শূন্যে। অদ্ভুত এই ঘটনার জন্যই মার্কো পোলো নিজের ডাইরিতে ‘ল্যান্ড অফ ফায়ার’ নামে লিপিবদ্ধ করলেন অঞ্চলটির কথা। কিন্তু কে জ্বালাল এই অগ্নিশিখা? আর তার জ্বালানিই বা জুটছে কোথা থেকে? 

আজারবাইজানের অ্যাবসারন অঞ্চলে গেলেই নজর কাড়বে এই অদ্ভুত দৃশ্য। স্থানীয় ভাষায় অঞ্চলটির নাম ‘ইয়ানার ডাগ’। যার অর্থ ‘জ্বলন্ত পর্বত’। ত্রয়োদশ শতক নয়, এই অগ্নিশিখা সেখানে জ্বলছে কমপক্ষে চার হাজার বছর ধরেই। পাহাড়ের মাঝেই অন্তত দশ মিটার বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে সেখানে অবিরত জ্বলছে আগুন। আর তাকে জীবন্ত রেখেছে প্রকৃতিই। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, প্রকৃতিই। এই আগুন মনুষ্যসৃষ্ট নয়। 

আজারবাইজানের গর্ভে লুকিয়ে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভাণ্ডার। ভূপৃষ্ঠের ফাটলের মধ্যে দিয়ে সেখান থেকেই কোনোভাবে নির্গত হচ্ছে সেই গ্যাস। কিন্তু কীভাবে এই লিক হওয়া গ্যাসে অগ্নিসংযোগ— তা আজও অজানা গবেষকদের কাছে। তবে শুধু ‘ইয়ানার ডাগ’-ই নয়, গোটা আজারবাইজান ধরেই বিভিন্ন অঞ্চলে এমন প্রাকৃতিক অগ্নিকুণ্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল কিছুদিন আগে পর্যন্তও। বর্তমানে একে একে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ জ্বালামুখই। ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ খনি থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস বার করে নেওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটামাত্র অগ্নিকুণ্ড বেঁচে রয়েছে সেখানে। 

তবে এই অগ্নিকুণ্ডের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আজারবাইজানের দীর্ঘ ইতিহাসও। এই প্রাকৃতিক অগ্নিকুণ্ড দীর্ঘকাল ধরেই অনুপ্রবেশকারীদের থেকে সুরক্ষা দিয়ে এসেছে আজারবাইজানকে। আর সেই কারণেই আজারবাইজানের সংস্কৃতি এবং ধর্মবিশ্বাসেও জায়গা করে নিয়েছে এই প্রাকৃতিক ঘটনা। সেখানকার ‘জোরোয়াস্ট্রিয়ান’ সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের বিশ্বাস এই আগুন মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির। আধ্যাত্মিকতার। সেজন্যই বছরের পর বছর ধরে সেখানে পুজোও করে আসা হয় অগ্নিদেবতার। প্রতিবছর প্রায় পনেরো হাজার পর্যটক ভিড় জমান এই অঞ্চলগুলিতে। আর তাঁদের অধিকাংশই আসেন ‘তীর্থ’ করতে। এই অগ্নিকুণ্ডই মনকে সতেজ রাখবে, অন্তরাত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দেবে— এমনটাই বিশ্বাস তাঁদের। আজারবাইজানে রয়েছে ‘অগ্নিদেবতা’-র আস্ত মন্দিরও।

আজারবাইজানের বাকু শহর থেকে পূর্বে কয়েকমাইল গেলেই মিলবে এমনই একটি মন্দির। আতেশগাহ মন্দির। বহু যুগ ধরেই সেখানে পুজো হয়ে আসছে অগ্নিকুণ্ডের। তবে মন্দিরটি স্থাপিত হয় হাল আমলে। সতেরো বা আঠারো শতকে ভারতীয় অভিযাত্রীরাই সেখানে গিয়ে তৈরি করেন এই মন্দির। আজারবাইজানের প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে মিশে যায় হিন্দু ধর্ম। পঞ্চভুজাকার সেই মন্দিরের একেবারে কেন্দ্রেই রয়েছে অগ্নিকুণ্ড। আর তাকে ঘিরে সার দিয়ে খান চব্বিশেক ঘর। তা মূলত স্থানীয় পুরোহিতদের আবাসস্থল। পাশাপাশি পর্যটক এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য আস্তাবল হিসাবেও ব্যবহৃত হয় সেগুলি। 

১৯৭৫ সালে এই মন্দিরকে মিউজিয়াম হিসাবে ঘোষণা করে আজারবাইজান প্রশাসন। ১৯৯৮ সালে তা হেরিটেজের তকমা পায় ইউনেস্কোর থেকেও। তবে বর্তমানে সেখানে আগুনের তেজ কমে এসেছে অনেকটাই। কমে এসেছে অগ্নিকুণ্ডের আয়তনও। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে ক্রমশ গ্যাস উত্তোলনের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে আজারবাইজান। এই গতিতেই খনিজ গ্যাসের উত্তোলন চলতে থাকলে আর কতদিন টিকবে এই প্রাকৃতিক অগ্নিকুণ্ড— তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়…

Powered by Froala Editor