পিকাসোর সঙ্গে প্রেম, তিক্ততা, বই ও ছবির সূত্রে পুনরুত্থান : জিলোর বর্ণময় জীবনকাহিনি

১৯৪৩ সাল। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট। ফ্রান্সের গারে দে ল’এস্তে রেলওয়ে স্টেশন ছেয়ে গেছে মানুষের ভিড়ে। হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছেন অন্যত্র। কেন-না নাৎসি সেনারা শহরে ঢুকে পড়লে প্রাণ বাঁচবে না কারোরই। সেই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে বছর কুড়ির এক তরুণী। ছলছল করছে চোখ। কারণ, ইহুদি হওয়ার জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তাঁর আঁকার শিক্ষক, কিংবদন্তি চলচ্চিত্র শিল্পী আন্দ্রে রোজসদা। তবে কার কাছে আঁকা শিখবেন তিনি? ছেড়ে দেবেন চিত্রশিল্পের নেশাকে? বুদাপেস্টের দিকে রওয়ানা দেওয়ার আগে তরুণীকে আশ্বস্ত করে গিয়েছিলেন আন্দ্রে। জানিয়েছিলেন, কয়েক মাসের মধ্যে কোনো-না-কোনোভাবে ঠিক পাবলো পিকাসোর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তাঁর। তিনি আন্দ্রের থেকেও ভালো শিল্পকলা শেখাবেন তাঁকে।

চিত্রশিল্পী ও লেখক ফ্রাঁসোয়াস জিলো (Francoise Gilot)। ফ্রান্সের রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে সেদিনের দীর্ঘশ্বাস ফেলা সেই তরুণীটি তিনিই। জিলোর আরও একটি পরিচয় হল, তিনি কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসোর একদা জীবনসঙ্গী। দীর্ঘদিন ধরেই হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন জিলো। সম্প্রতি ম্যানহাটনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ১০১ বছর। 

১৯২১ সালে নুয়েলি-সুর-সিয়েনের এক সম্ভ্রান্ত প্যারিসীয় পরিবারে জন্ম জিলোর। বাবা ব্যবসায়ী, মা চিত্রশিল্পী। ফলে, কৈশোর থেকেই শিল্পচর্চার পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা তাঁর। মায়ের কাছেই জলরঙে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর। পরবর্তীতে পারিবারিক সূত্রে আন্দ্রে রোজসদাকে আঁকার শিক্ষক হিসাবে পান জিলো। শুরু হয় পরাবাস্তববাদী চিত্রকলার পাঠ। ততদিনে ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ডিগ্রিলাভ করেছেন তিনি। প্যারিসের ব্রিটিশ ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন আইনি বিভাগে। তার মধ্যেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বযুদ্ধ। বছর কয়েকের মধ্যে নিরাপত্তার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তাঁর শিক্ষক আন্দ্রে। আর আন্দ্রের শেষ কথাটিই ভবিষ্যতবাণী হয়ে ওঠে কালের আবহে। 

আন্দ্রে চলে যাওয়ার ঠিক সাত মাস পরের কথা। প্যারিসের এক পানশালায় পিকাসোর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয় জিলোর। বাক্যালাপ শুরু করেছিলেন জিলো নিজেই। কয়েকদিনের মধ্যেই পিকাসোর ব্যক্তিগত স্টুডিও ঘুরে দেখার সৌভাগ্যও হয় তাঁর। এরপর যত সময় গড়িয়েছে, ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে তাঁদের সম্পর্ক। এমনকি শেষ পর্যন্ত সংসার করার আশায় ৬১ বছর বয়সি পিকাসোর সঙ্গে ঘর করা শুরু করেছিলেন ২১ বছরের তরুণী জিলো।

১৯৪৩ থেকে শুরু করে ১৯৫৩— প্রায় ১০ বছর পিকাসোর জীবনসঙ্গী ছিলেন জিলো। অথচ, জিলোর সঙ্গে সম্পর্কে থাকার সময় প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে আইনিভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি পিকাসোর। এমনকি জিলোকেও স্ত্রী-এর স্বীকৃতি দেননি তিনি। ধীরে ধীরে সেখান থেকেই তিক্ত হয়ে ওঠে সম্পর্ক। যার ফলস্বরূপ দুই সন্তানকে নিয়ে সংসার ছাড়তে বাধ্য হন জিলো।

জিলোর কথায়, আন্দ্রের ভবিষ্যতবাণী শুধু সত্যিই হয়নি, আশীর্বাদের বদলে যেন অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছিল তাঁর জীবনে। এই সম্পর্কই গ্রাস করেছিলেন তাঁর শিল্পীজীবনকে। পিকাসোর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর এক-কথায় একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন জিলো। তাঁর ছবির প্রদর্শনী ও ক্রয়-বিক্রয় ঠেকাতে ফ্রান্সের গ্যালারিগুলিকে নানাভাবে চাপ দিয়েছিলেন পিকাসো, উঠেছিল এই অভিযোগও। 

১৯৬৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর স্মৃতিকথা ‘লাইফ উইথ পিকাসো’। পিকাসোর জীবনসঙ্গী হয়ে ১০ বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা ঠিক কেমন, তা অকপটে প্রকাশ্যে এনেছিলেন জিলো। যা নিয়ে আইনি লড়াই-ও শুরু হয়েছিল স্প্যানিশ শিল্পীর সঙ্গে। তবে শেষ পর্যন্ত এই গ্রন্থ হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার। অন্যদিকে আইনি লড়াইয়ে হেরে জিলো এবং তাঁর দুই সন্তানের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন পিকাসো। 

বলতে গেলে, এই গ্রন্থই পুনরায় কর্মজীবনে ফিরিয়ে এনেছিল জিলোকে। জিলো-পিকাসো বিতর্কের পর প্যারিস তো বটেই, নিউইয়র্ক ও লন্ডনের একাধিক গ্যালারি ও মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হতে থাকে জিলোর ছবি। এমনকি সে-সময় নিলামে ১৩ লক্ষ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়ে নতুন নজির গড়েছিল তাঁর আঁকা ছবি ‘পালোমা আ লা গিটার’। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জিলোকে। বিশ্বের কিংবদন্তি মহিলা চিত্রশিল্পীদের তালিকাতে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। 

১৯৭০ সালে আমেরিকান চিকিৎসক জোনাস সালকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন জিলো। স্থানান্তরিত হন ক্যালিফোর্নিয়ায়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অধ্যাপনা করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় ফাইন আর্টস বিভাগে। ছিলেন ডিরেক্টরও। ১৯৮৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর ভারত, সেনেগাল এবং ভেনিস ভ্রমণের ওপর বেশ কিছু স্কেচের বই প্রকাশ করেছেন তিনি। এমনকি ১৯৭৫ সালে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর আরও একটি স্মৃতিকথা ‘ইন্টারফেস : দ্য পেইন্টার অ্যান্ড দ্য মাস্ক’। বিশ্বের পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছিল সেটিও। নব্বইয়ের দশকে এবং চলতি শতকেরও প্রথম দিকেও অব্যাহত ছিল তাঁর শিল্পীজীবন। পুনর্জাগরণের ওপর বিভিন্ন সিরিজ-পেইন্টিং এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন জিলো। তাছাড়াও তরুণ ও মহিলা শিল্পীদের জন্যও নিয়েছিলেন একাধিক উদ্যোগ। সবমিলিয়ে তাঁর প্রয়াণে যেন ইতি পড়ল চিত্রশিল্পের এক বর্ণময় অধ্যায়ে…

Powered by Froala Editor