‘ইংরেজরা বাংলা জানলে প্রশ্ন উঠত, বাঙালিদের স্টাইলে উপন্যাস লেখে কিনা’

স্মৃতিটা এখনও ছবির মতো স্পষ্ট, চোখের সামনে ভাসছে যেন। ২০১৪ সাল, সেইল-আইএসপি’তে চাকরি পেয়ে সদ্য সদ্য আসানসোলে এসে থিতু হয়েছি। নম্বর জোগাড় করেছিলাম আগেই; এক শনিবার সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে দুরুদুরু বুকে ফোনটা করেই ফেললাম প্রিয় লেখককে। ‘আমি কি অনীশ স্যারের সঙ্গে কথা বলছি?’ নার্ভাস প্রশ্নের উত্তরে সহজ গলায় ‘হ্যাঁ, বলছি’। প্রায় একঘণ্টা কথা হয়েছিল। বেশি বকবক আমিই করেছিলাম; ‘তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট’, ‘রইল না আর কেউ’, ‘হারিয়ে যাওয়া’—পছন্দের গল্প উপন্যাস নিয়ে কত কীই না বলেছিলাম, ভালো লাগা মন্দ লাগা সব ডিটেইলে জানিয়েছিলাম। একটুও অধৈর্য হননি আপনি, একগাদা কৌতূহল মিটিয়েছিলেন স্নেহভরে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা স্যার, তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিটের ওই যে পিট ফাইটের সিন, ওটা কি আপনি জো আর ল্যান্সডেল-এর গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন?’ উত্তরে আপনি পালটা প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘তুমি ল্যান্সডেল পড়েছ নাকি?’ লাজুকভাবে ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। তারপর কথায় কথায় কীভাবে যেন এসে গিয়েছিল রবার্ট ব্লক, স্টিফেন কিং, রিচার্ড ম্যাথেসন-এর প্রসঙ্গ, পাশ্চাত্য জঁর ফিকশনের খুঁটিনাটি। ফোন রাখার আগে আপনি বলেছিলেন, “কথা বলে ভালো লাগল, সৌভিক। মাঝে মাঝে ফোন কোরো।” গত সাতবছর ধরে আমি তাই করেছি, স্যার। যখন ইচ্ছে হয়েছে, আপনাকে ফোনে ধরেছি। কিন্তু আজ আপনার ফোনটা শুধু রিং-ই হয়ে যাচ্ছে, কেউ ধরছে না।    

যখন প্রথম লেখা শুরু করেন আপনি, তখন আপনার বয়স (আপনার নিজের ভাষায়) ‘ষোলো প্লাস’। অর্থাৎ সময়টা ষাটের দশকের শেষদিক, বাংলা পাল্প পত্রিকার স্বর্ণযুগ। স্টলে গেলেই পাওয়া যেত হাতেগরম ‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য পত্রিকা’, ‘মাসিক গোয়েন্দা’। কিশোরবেলায় এগুলোই পড়তে ভালোবাসতেন আপনি, তাই লেখার দুনিয়ায় পা রাখলেন রহস্য রোমাঞ্চ দিয়েই। চুটিয়ে লিখলেন ম্যাগাজিনগুলোতে—ক্রাইম, ডিটেকটিভ, মিস্ট্রি কাহিনি। তথাকথিত ‘ধ্রুপদী’ ঘরানার লেখকরা যাকে ‘অন্ত্যজ’ বলে মনে করতেন, সেই ধরনের সাহিত্যের চর্চা করতে কোনোদিন লজ্জা করেনি আপনার। বরং গর্ব করে বলেছেন, “সারাজীবন এগুলোই লিখতে চেয়েছি, লিখেছিও। যেদিন লিখতে পারব না, ‘ক্লোক অ্যান্ড ড্যাগার’ তাকে তুলে রেখে দেব।” পরবর্তী সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন, পাঠকের মন ছুঁয়ে যাওয়া সামাজিক আখ্যান লিখেছেন নামি পত্রিকার পাতায়, কিন্তু মন আপনার পড়ে থেকেছে রহস্য-রোমাঞ্চেই। বাংলা সাহিত্যে অবহেলিত এই ধারাকে আপনি অন্তর থেকে কতটা ভালোবাসতেন তার পরিচয় আমরা পাই ‘বিশ্বাসঘাতকদের জন্য’ উপন্যাসে। চমৎকার এই ‘লকড রুম মিস্ট্রি’-র অধিকাংশ চরিত্রকেই আপনি গড়েছিলেন আপনার সমসাময়িক রহস্য-রোমাঞ্চ লেখকদের আদলে। প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, প্রসাদগুণে পাল্প ফিকশনও উৎকৃষ্ট শিল্প হয়ে উঠতে পারে। আপনার লেখা পড়েই তো আমরা শিখতাম, স্যার। এত তাড়াহুড়ো করলেন কেন বলুন তো? কতকিছু শেখার, জানার বাকি রয়ে গেল!      

বাংলা কল্পবিজ্ঞানের আঙিনায় নবজাগরণের যে জোয়ার শ্রদ্ধেয় অদ্রীশ বর্ধন এনেছিলেন, তাতে সোৎসাহে আপনিও নৌকো ভাসিয়েছিলেন। কল্পবিজ্ঞানের নিবেদিতপ্রাণ লেখক হওয়ার অনেক আগে থেকেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন আপনি। নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতেন, “প্রেমেন্দ্র মিত্রকে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের শেক্সপিয়ার বলা যেতেই পারে”, অকপট প্রশংসা করতেন দিলীপ রায়চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, সিদ্ধার্থ ঘোষের লিখনশৈলীর। বারবার বলতেন সেই দিনের কথা, যেদিন প্রথমবারের জন্য ‘আশ্চর্য’ পত্রিকা হাতে নিয়েছিলেন। “অ্যাস্টাউন্ডিং পত্রিকার সম্পাদক জন ক্যাম্পবেল-কে যদি তাঁর অবদানের জন্য একবার প্রণাম জানাই, তাহলে অদ্রীশদাকে দশবার জানাব, কারণ তাঁর কাজটা ছিল অনেক দুরূহ”— অগ্রজের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন আপনি, হাসিমুখে শুনিয়েছেন কীভাবে যুবক বয়সে লোকাল ট্রেনে ঘুরে ঘুরে ম্যাগাজিন বিক্রি করতেন স্রেফ হৃদয়ের তাগিদ থেকে। আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখক টমাস এম ডিশ-এর সঙ্গে কীভাবে আলাপ হয়েছিল, কীভাবে জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার এবং বাল ফোন্ডকে-র কাছে তাঁদের গল্প বাংলায় অনুবাদ করার অনুমতি চেয়ে নিয়েছিলেন, কোন কোনো ইংরেজি কল্পবিজ্ঞান গল্পের অনুবাদ আপনি করেছিলেন ‘প্রসাদ’ পত্রিকার জন্য—গল্পগুলো আরেকবার শুনতে ইচ্ছে করছে যে। কে শোনাবে বলুন তো? আচ্ছা মনে আছে স্যার, আপনার একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম আমি, বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ওপর? বলেছিলাম, অনুলিখন করে আপনাকে দেখাব। সময়ই পেলাম না। 

ভৌতিক অলৌকিকের দুনিয়ায় আপনার অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। শার্লি জ্যাকসন-এর ‘দ্য হন্টিং অফ হিল হাউজ’ যেমন ভালোবাসতেন, তেমনই ভালোবাসতেন শরদিন্দুর ভূতের গল্প। প্রায়ই বলতেন, “আমি সিরিয়াস ভূতের গল্প লিখতেই পছন্দ করি; আমার ভূত হাসাবে না, ভয় দেখাবে।” ‘আমি পিশাচ’, ‘তুমি পিশাচ’, ‘পিশাচের রাত’ উপন্যাসগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে কম আলোচনা হয়েছে! ‘ভ্যাম্পায়ার আর ওয়্যারউলফ-কে তো বাংলা সাহিত্যে আপনিই জাতে তুলেছেন”, বলতাম আমি, কিন্তু আপনি মানতে চাইতেন না। বরং উল্লেখ করতেন এফ পল উইলসন-এর ‘মিডনাইট মাস’ গল্পের কথা। “এত ভালো লেখা, ইচ্ছে হয় বাংলায় অনুবাদ করি।” কেন করলেন না স্যার? ‘জলের মতো কঠিন’, ‘পাশবিক’ ইত্যাদি গল্পের আইডিয়া কীভাবে পেয়েছিলেন তা জানতে চেয়ে অনেকবার জ্বালিয়েছি আপনাকে, ‘ভয়পাতাল’ উপন্যাসটা আদৌ লাভক্র্যাফটিয়ান কিনা, তা নিয়ে দীর্ঘ ফোনালাপ চালিয়েছি। একবারের জন্যও বিরক্ত হননি আপনি, কখনো বলেননি, “এখন ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব।” যখন প্রশ্ন করেছি, “ভূত, প্রেত, পিশাচ, সাইকোলজিক্যাল হরর নিয়ে কেন লেখেন এত?”, স্টিফেন কিং-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “হোয়াট মেকস ইয়ু থিংক আই হ্যাভ আ চয়েস?” ভাবলেই গলায় কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছে, এই কথাগুলো আর কোনোদিন শুনতে পাব না।  

বিদেশি থ্রিলার পড়তে বড়ো ভালোবাসতেন আপনি। জেমস এম কেইন-এর ‘দ্য পোস্টম্যান অলওয়েজ রিংস টোয়াইস’, জন গডি-র ‘টেকিং অফ পেলহ্যাম ১২৩’, লরেন্স স্যান্ডার্স-এর ‘দ্য ফার্স্ট ডেডলি সিন’—ফোনের ওপারে একের পর এক উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করতেন, আর এপারে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। অ্যালিস্টার ম্যাকলিন-এর প্রায় সবকটা বই-ই আপনার পড়া ছিল, লী চাইল্ড-এর নায়ক জ্যাক রিচার-এর চরিত্র বিশ্লেষণ করতেন অনায়াস দক্ষতায়। স্টিফেন কিং-এর ‘ডোলান’স ক্যাডিলাক’ গল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কতবার যে শুনেছি আপনার মুখে! পড়াশোনার ব্যাপ্তি বিশাল ছিল বলেই বাংলা থ্রিলারে পাশ্চাত্য স্বাদ-গন্ধ মাখাতে সক্ষম হয়েছিলেন আপনি। “‘কিরাত আসছে’ আমার পড়া অন্যতম সেরা অ্যাকশন থ্রিলার”—যখনই বলতাম, আপনি সঙ্গে জুড়ে দিতেন, “উপন্যাসটা লেখার সময় জাল নোট নিয়ে রীতিমতো খোঁজখবর নিয়েছিলাম বিভিন্ন জায়গায়।” ‘সাপের চোখ’, ‘পাতালঝড়’, ‘সামান্য ঝুঁকি’—গোগ্রাসে গিলেছি, আর মুগ্ধ হয়েছি। যখনই মজা করে জানতে চেয়েছি, “আচ্ছা স্যার, আপনি কি বিদেশি লেখকদের মতো করে লেখেন?”, আপনি দ্বিগুণ মজা করে উত্তর দিয়েছেন “নেহাত ইংরেজরা বাংলা পড়তে পারে না, নাহলে ওদেরও কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করত আপনারা কি আপনাদের উপন্যাসগুলো বাঙালিদের মতো করে লেখেন!” আর কেউ বলবে এমন করে?       

“লেখক অনীশ দেব আমার প্রিয়, তার চেয়েও প্রিয় সম্পাদক অনীশ দেব”— বলেছিলাম আপনাকে, আর আপনি মুচকি হেসেছিলেন। একটুও বাড়িয়ে বলিনি কিন্তু। আপনার নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আপনার সম্পাদিত সংকলনের হাত ধরেই। আনন্দ থেকে প্রকাশিত ‘সেরা কিশোর কল্পবিজ্ঞান’ যখন হাতে পাই, তখন আমার দশ বছর বয়স। এক নিঃশ্বাসে শেষ করেছিলাম। তারপর একে একে ডুবেছি ‘সেরা কল্পবিজ্ঞান’, ‘খুনির রঙ’, ‘রহস্য রোমাঞ্চ গোয়েন্দা পত্রিকার সেরা ১০০ গল্প’, ‘সেরা ১০১ ভৌতিক অলৌকিক’ সংকলনে। ইংরেজি সংকলনও সম্পাদনা করেছেন আপনি, প্রথমে দেব সাহিত্য কুটীর এবং পরে বী বুকস থেকে। পড়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি। আমার মধ্যে সম্পাদনার নেশাও তো আপনিই জাগিয়েছিলেন, স্যার। বী বুকস-এর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ, ‘অ্যান্থোলজি অফ টোয়েন্টি স্টোরিজ: সায়েন্স ফিকশন’ সংকলনের সম্পাদনা, আপনি না থাকলে হতই না। ২০১৬ বইমেলায় বেরিয়েছিল বইটা, ভূমিকায় আপনি লিখেছিলেন-- “I have known Souvik for about one and half years, give or take a couple of months...through extra-long conversations, each time any one of us called the other, we discussed mostly SF. If any publisher was interested to publish all our conversations, that would have made at least a 500 page book on SF. Oh no, may be more than that!” 

সে আর হল কই? আপনি তো ধরাছোঁয়ারই বাইরে চলে গেলেন, আমার ওপর অশেষ ঋণের চাপিয়ে। বাইপাs সার্জারি থেকে অবলীলায় ফিরে আসতে পেরেছিলেন, কোভিড থেকে এলেন না কেন? 

বড্ড মনখারাপ লাগছে। ছুরি আর ওভারকোট নামিয়ে রাখার এত তাড়া ছিল আপনার, স্যার? কত কথা না বলাই রয়ে গেল যে!

Powered by Froala Editor