কয়েকটি মাত্র শব্দ জুড়ে জুড়ে ধর্মসংগীতকে প্রতিবাদের গানে বদলে নিলেন পিট সিগার

‘দেশদ্রোহী’। ‘কমিউনিস্ট’। ‘সন্ত্রাসবাদী’। একটা ১৮০০ পাতার মোটা ফাইলে এমন কিছু শব্দ পাওয়া যাবে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’ একজন মানুষকে নিয়েই এই বিরাট আয়তনের ফাইলটি তৈরি করেছিল। সেখানে ছিল তাঁর জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি। ‘সন্দেহজনক’ নানা কার্যকলাপ। দেশের তো ‘ক্ষতি’-ই করে গিয়েছেন সারাটা জীবন। কখনো কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্বেষ নিয়ে রাস্তায় নামছেন। ভিয়েতনামে যুদ্ধবিধ্বস্ত সৈনিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। গাইছেন, ‘ওয়েইস্ট ডিপ ইন দ্য বিগ মাডি’-র মতো গান।

শ্রমিকের হাতুড়ির শব্দে মিশে যাচ্ছে ব্যানজোর সুর…

কিংবদন্তি লোকগায়ক উডি গাথরির উত্তরসূরি দুইজন। সেই গাথরি, যিনি গেয়েছিলেন ‘দিস ল্যান্ড ইজ ইওর ল্যান্ড’, যাঁর গিটারের উপর লেখা থাকত ‘দিস মেশিন কিলস ফ্যাসিস্টস’। তাঁর ছাত্রদের একজনের নাম রবার্ট জিমারম্যান ওরফে বব ডিলান। ফোক-গায়ক থেকে যিনি সহসা রকস্টার হয়ে উঠবেন। হাতে উঠবে ইলেকট্রিক গিটার। অন্যজন ব্যানজো হাতেই কাটাবেন গোটা জীবনখানা। মাঠে ময়দানে, যেমনভাবে গুরুর সঙ্গে ঘুরেছেন, পাবে-ক্লাবে বাজিয়ে বুকে যেমনভাবে জড়িয়েছিলেন হাটুরে মানুষদের, তেমনভাবেই থাকবেন তিনি আজীবন। পিটার সিগার, বা লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রিয় ‘পিট’ হয়ে।

প্রতিবাদের গানে কোনোদিন কখনো কপিরাইট ছিল না। তা সৃষ্টি হয়েছে সুরের নিয়মে। যেমনভাবে, শেকল বাজাতে বাজাতে ক্রীতদাসরা গেয়েছিল ‘ব্লুজ’। জ্যাজ এবং ব্লুজ আর প্রার্থনা সঙ্গীত ভেঙে অন্ধ গায়ক রে চার্লস প্রতিষ্ঠা করছিলেন ‘সোল’ ঘরানাকে। ঠিক তেমনভাবেই মার্কিন ‘ফোক’-সংগীত তৈরি হচ্ছিল ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়েই। যেমন সিগারের “টার্ন টার্ন টার্ন’ গানটির উৎপত্তি ‘কিং জেমস বাইবেল’ থেকে। বাইবেলের ‘বুক অফ একলেসিয়েস্টেস’-এর তিন নম্বর চ্যাপ্টার প্রথম আট লাইন বেমালুম তুলে নিয়ে, সুর বসিয়ে ফেলেছিলেন পিট সিগার। তারপর, ‘এ টাইম ফর পিস, আই সোয়ার ইটস নট টু লেট’ লাইনটি যোগ হল শুধু…

ধর্মসংগীত কখন যে প্রতিবাদের গান হয়ে ওঠে, কেউ জানতে পারে না। মাথায় রাখতে হবে, ৫০-৬০ দশকে কালো মানুষদের কাছে গির্জাগুলোই ছিল আন্দোলনের ঘাঁটি। কিন্তু যখনই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই হিংসার আকার নিচ্ছে, তখনই সরে এসেছেন সিগার। তাঁর ‘অস্ত্র’ থেকে কখনও গুলি বেরোয়নি।

হাডসন নদীর ধারে কাঠের কেবিন। ফকিরি পিট তাঁর সাধনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জাপানি ‘তোশি ওতা’-কে। শেষ বয়সেও তিনি পরিবেশ আন্দোলনের শরিক। অশীতিপর হাত ঝংকার দিল তারে। শতাব্দী শেষের পথেও জানিয়েছেন পিট, “আমরা ভয় পাইনি। পাব না।”

একটা গল্প তাঁর প্রিয় ছিল খুব। গানের মাঝপথে থেমে বলতেন প্রায়ই। পঞ্চাশের দশকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে একটা পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়েছিল একজন। একাকী। পথচারীদের টিটকিরি গায়ে না মেখে। একজন তো সোজা প্রশ্ন করে বসেন, রাগিয়ে দেওয়ার ছলে, “মাঝরাত্তিরে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে আছ যে, দুনিয়াটা বদলাতে পারবে?” খুব শান্ত গলায় পোস্টারধারী উত্তর দেয়, “হয়তো আমি বদলাতে পারব না কাউকে, কিন্তু দুনিয়াটা পাল্টাতে পারবে না আমাকেও।”

শাসনযন্ত্রের সামনে শতবর্ষ পেরনো এক বিশাল বটগাছের মত দাঁড়িয়ে রয়েছেন বৃদ্ধ সিগার। পাখির ডানার দু’টি হাত বাড়িয়ে বলছেন, ‘ইউ শ্যাল নট বি মুভড…’