বিয়ের আগে কুমারীত্বের সার্টিফিকেট! মধ্যযুগীয় নিয়ম আজও বহাল ইরানে

মাস কয়েক আগের কথা। বিস্ময়কর এক আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছিল ইরান (Iran)। যে-দেশে যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা এক প্রকার ঘৃণ্য কাজ, সেখানেই অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছিলেন দেশের প্রায় ২৫ হাজার নারী। দাবি, বন্ধ করতে হবে কুমারীত্বের পরীক্ষা।

হ্যাঁ, বিবাহের আগে কুমারীত্বের (Virginity Test) সার্টিফিকেট দেখাতে হয় ইরানের অধিকাংশ মহিলাকে। এটাই সেখানকার সামাজিক নিয়ম। কয়েকশো বছর ধরেই ইরানে চলে আসছে এমনই বর্বরোচিত প্রথা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, কুমারীত্ব পরীক্ষা নিয়ে উত্তরোত্তর প্রতিবাদ বেড়েছে ইরানে। যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ কুমারীত্ব পরীক্ষা নিষিদ্ধ করার পক্ষে গণ-পিটিশন। যৌনতা নিয়ে এত বড়ো গণ-আন্দোলন ইরানে এই প্রথম। 

এই গণ-আন্দোলনের নেপথ্যে রয়েছেন দক্ষিণ ইরানের বাসিন্দা মরিয়ম। বলতে গেলে তিনিই প্রথম প্রকাশ্যে সরব হয়েছিল কুমারীত্ব পরীক্ষা নিয়ে। আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বিবাহের পর যৌনমিলনের সময় রক্তক্ষরণ হয়নি মরিয়মের। সেখান থেকেই সূত্রপাত পারিবারিক অশান্তির। এই ঘটনার পরেই তাঁকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চিকিৎসকের কাছে। করা হয়েছিল পরীক্ষা। অবশ্য, চিকিৎসক জানিয়েছিলেন বিবাহের আগে সম্ভবত তাঁর যৌনমিলন হয়নি। হাইমেন বা যোনিপর্দা প্রসারণশীল হওয়ায় রক্তক্ষরণ হয়নি সেখান থেকে। তবে এই সনদপত্রেও লাভ হয়নি কোনো। ‘অসতীত্ব’-এর অপরাধে দিনের পর দিন স্বামীর কুমন্তব্য ও অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। 

ক্রমাগত এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, একটা সময় ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন তিনি। তবে সফল হয়নি তাঁর প্রচেষ্টা। সুস্থতায় ফেরার পর আইনি লড়াই-এর পথে হাঁটেন মরিয়ম। প্রথম আইনি পথে বিবাহবিচ্ছেদ, তারপর কুমারীত্ব বন্ধ করার লড়াই। তাঁর সেই লড়াই-এর সূত্র ধরেই গণ-পিটিশনে স্বাক্ষর করেন দেশের ২৫ হাজারের বেশি মহিলা। 

কুমারীত্বের পরীক্ষা যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তা বহুবছর আগেই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এমনকি এই প্রথা মানবাধিকারের পরিপন্থী, তাও স্পষ্ট করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ। দীর্ঘ টালবাহানার পর, গতবছর জাতিসংঘের এই আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইন্দোনেশিয়া। তবে এখনও পর্যন্ত কুমারীত্ব পরীক্ষা নিয়ে খুব একটা হেলদোল নেই ইরান প্রশাসনের। বরং, দেশের প্রায় সমস্ত ক্লিনিককেই কুমারীত্ব পরীক্ষা করার ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছে সে-দেশ। এমনকি কুমারীত্বের সার্টিফিকেটে উল্লেখ করা হয় মহিলার জাতীয় পরিচয়পত্র, বাবা-মায়ের নাম ও অন্যান্য সমস্ত তথ্য। 

এই প্রথা শুধু সম্মানহানীকরই নয়, ইরানে এই সমস্যার বীজ ছড়িয়ে রয়েছে আরও গভীরে। সামাজিক এই ভীতিকে কাজে লাগিয়েই রীতিমতো ব্যবসাও চলছে ইরানে। দেশের নানা প্রান্তেই গজিয়ে উঠেছে বহু বেসরকারি ক্লিনিক। সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে জোড়া লাগানো হয় যোনিপর্দায়। সবটাই হয় গোপনে, বেআইনিভাবে। তবে সেই অস্ত্রোপচার যে সবসময় সফল হয়, এমনটাও নয়। অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হয়েছে, ইরানে এমন উদাহরণও রয়েছে ভুরি ভুরি। কেউ কেউ আবার বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যার পথ। 

তারপরেও বিন্দুমাত্র বদলায়নি সমাজের মানসিকতা। অনেক নারীর অভিভাবকরাও সমর্থন করে আসছেন এই রীতিকে। কেউ আবার প্রকাশ্যেই স্বীকার করেন, বিবাহের আগে একাধিক নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করলেও, নারীদের সেই অধিকার নেই। বরং, কুমারীত্ব হারানো নারীদের স্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা থাকে না। আদৌ কি এই পুরুষতান্ত্রিকতার যবনিকাপতন হবে কোনোদিন? জানা নেই উত্তর। তবে ইতিবাচক বিষয় হল, অধিকার আদায়ের পক্ষে ধীরে ধীরে ট্যাবু ভেঙে রাস্তায় নামতে শুরু করেছেন ইরানের মহিলারা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More