৭২ বছর পরে রূপকথার মিলন স্বাধীনতা সংগ্রামী আর তাঁর হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীর

“জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!”

কুড়ি বছর ঠিক কতখানি ছোট ৭২ বছরের থেকে? অবাক লাগছে এমন বেয়াড়া প্রশ্ন শুনে? কেরলের নারায়াণন নাম্বিয়ার আর সারদার গল্প শুনলে আর মোটেই বেয়ারা মনে হবে না এই প্রশ্নকে। গল্পই বা বলছি কেন? একে বরং বলা উচিত সত্যি রূপকথা।

ঠিক ৭৩ বছর আগে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন নারায়াণন আর সারদা। সারদা তখন ১৪ বছরের কিশোরী। নারায়াণনও বয়সে আহামরি বড় নন, তাঁর বয়স ১৮। কিশোর-কিশোরীর দাম্পত্যে মুগ্ধতার ঘোর লেপ্টে ছিল ভালোই। কিন্তু সময়টা অস্থির। ব্রিটিশ সরকারের পদলেহনকারী সামন্তপ্রভুর অত্যাচারে বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন কেরলের কৃষকরা। নারায়াণনের বাবা থালিয়ান রামন নাম্বিয়ারও কৃষক। বাবার সঙ্গে নারায়াণনও সামিল হলেন কাভুমবাই কৃষক আন্দোলনে। সেটা ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর। নারায়াণন-সারদার বিয়ে হয়েছে তার মাত্র ৮ মাস আগে।

এক রাত্রে সামন্তপ্রভুর বাড়ি আক্রমণ করলেন বিদ্রোহী কৃষকরা। সেই দলে ছিলেন নারায়াণন ও তাঁর বাবাও। কিন্তু আগে থেকেই খবর পেয়ে ব্রিটিশ সরকারের মালাবার স্পেশাল পুলিশও পৌঁছে গেল সেখানে। গুলিতে বিদ্রোহীদের অনেকে প্রাণ দিলেন। কোনওমতে পালিয়ে গা ঢাকা দিলেন নারায়াণন আর তাঁর বাবা। তখনও নারায়াণন ভাবতে পারেননি, তাঁর দাম্পত্যে অকাল বিচ্ছেদ বুনে দেবে এই বিদ্রোহের রাত।

দু’মাস পরে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন দু’জনেই। জেলবন্দি হলেন। ইতিমধ্যে তাঁদের বাড়ি তছনছ করে পুড়িয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। সেদিন ১৪ বছরের কিশোরী পুত্রবধূকে হিংস্র পুলিশের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন নারায়াণনের মা। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এইভাবে আদরের পুত্রবধূটিকে বেশিদিন একা রক্ষা করতে পারবেন না তিনি। সারদাকে ফের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

একসময় জেল থেকে ছাড়া পান নারায়াণনও। তাঁর স্ত্রী তখন অন্য পুরুষের ঘরনি। স্বল্পস্থায়ী দাম্পত্যের স্মৃতি বারবার হানা দেয়। ক্রমে ক্ষত শুকিয়েও আসে। নতুন বিয়ে করেন নারায়াণনও। জীবনের একটা পরিচ্ছেদ যেন মুছে যায়। যা থাকার, তা কেবলই ছিল স্মৃতিতে, রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কান্নায়। আর যে ফেরার পথ নেই, তা বেশ ভালোই জানতেন সারদা এবং নারায়াণন।

কিন্তু, জীবনে শেষ কথা কে-ই বা আর বলতে পারে! তাই একদিন নারায়ণনের ভাইঝি সান্থা-র কাছে এসে হাজির হলেন সারদার ছেলে ভার্গবন। সান্থা ইতিমধ্যেই কাকার জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাসে ঠাঁই পেয়েছে ডিসেম্বরের সেই রাত, কাকার প্রথম দাম্পত্যের কথাও। সেই উপন্যাস পড়েই সান্থার কাছে আসেন ভার্গবন। জানান, সারদা এখনও বেঁচে। তাঁর প্রথম দাম্পত্যের স্মৃতিও বেঁচে। বয়স শরীরে থাবা বসিয়েছে, কিন্তু অনুভূতি মুছতে পারেনি।

বেঁচে যে আছেন নারায়ণনও। হয়ত সারদা-কে দেখবেন বলেই। অতএব, দীর্ঘ ৭২ বছর পর ফের দেখা হল নারায়ণন-সারদার। ১৪ বছরের কিশোরী আর ১৮ বছরের কিশোর এত্তগুলো বছর পরে পরস্পরের দিকে তাকালেন। মুখে অসংখ্য বলিরেখা। এরই ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে ফেলে আসা সেই সময়। এত সময় পেরিয়ে কি চেনা যায় পুরোনো মানুষদুটিকে? সারদার চোখে জল। আবেগে ভেসে যাচ্ছেন নারায়ণনও। বড় দেরি হয়ে গেল যে। বড় বেশি দেরি…

যা চলে গেছে, তাকে ফেরাবে কার সাধ্যি! কিন্তু অকাল বিচ্ছেদের পরে এই মিলনটিও যে কম অবিশ্বাস্য নয়। সারদা-নারায়ণনের গল্পকে তাই রূপকথা বললে আপত্তি কি?

ছবি ঋণ - নৌশিন খান