বিপদের মুখে বইবাজারও, তালিবান রাজত্বে ত্রস্ত আফগান ব্যবসায়ীরা

রাস্তার ধারে সার দিয়ে বইয়ের দোকান। কিন্তু অধিকাংশ দোকানেরই ঝাঁপ ফেলা দোকানের। যেগুলি খোলা রয়েছে সেখানেও পছন্দের কোনো বই খোঁজাই দায়। কেননা, আলো নেই কোনো। ‘অপ্রয়োজনীয়’ তাই বিদ্যুৎ বাঁচাতে বন্ধ করে রাখা হয়েছে দোকানের আলো। অন্ধকার হাঁতড়েই টিমটিম করে জ্বলছে বইয়ের ব্যবসা (Book Selling)।

কথা হচ্ছে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থিত আফগানিস্তানের (Afghanistan) বৃহত্তম বই বাজার (Book Market) নিয়ে। কলকাতার কাছে কলেজস্ট্রিট যেমন, ঠিক সেরকমই কাবুলের এই বই বাজার আফগান বইপ্রেমীদের কাছে স্বর্গসম। কয়েকশো মানুষের রুটিরুজির জায়গাও বটে। কিন্তু তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যেন কোণঠাসা হয়ে উঠেছে গোটা অঞ্চলটাই। কঠিন ভবিষ্যতের সম্মুখীন বই ব্যবসায়ীরাও।

আজ থেকে আড়াই দশক আগের কথা। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে জারি ছিল তালিবান রাজত্ব। বই ব্যবসায়ীরা তো বটেই এমনকি পড়ুয়ারাও সেসময় চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল তালিবানের। কেননা, তালিবানের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামে বই ‘অপবিত্র’। তাই সমস্ত সাহিত্যকর্মকেই নিষিদ্ধ করেছিল তালিবান। এমনকি বাড়ি বাড়ি ঢুকে রীতিমতো তল্লাশি চলত আফগানিস্তানে। ‘ইসলাম বিরোধী’ বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেলে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হত সংশ্লিষ্ট বইয়ের মালিককে।

সেই অন্ধকার যুগই আবার যেন ফিরতে চলেছে আফগানিস্তানে। না, এখনও পর্যন্ত সাহিত্যকর্ম কিংবা বইয়ের ওপরে সরাসরি কোনো ফতোয়া জারি করেনি তালিবান শাসকরা। তবে গোটা দেশজুড়ে ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে এক ভয়ের পরিবেশ। যার সূত্রপাত হয়েছিল প্রাক্তন মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামার আত্মজীবনী ‘বিকামিং’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই। অন্যান্য দেশের মতো আফগান বাজারেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই বইটির সংস্করণ। বইটির প্রচ্ছদে মিশেল ওবামার ছবি নিয়েই প্রথম প্রশ্ন তোলে তালিবানরা। কারণ, সেই ছবিতে হিজাব নেই মিশেলের পরনে। 

আরও পড়ুন
দেশছাড়া আফগানিস্তানের শেষ ইহুদি, আশ্রয় পাচ্ছেন ইজরায়েলে


আরও পড়ুন
আফগানিস্তানের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য লড়ছেন নেমাত সাদাত, সাক্ষী কলকাতাও

সংশ্লিষ্ট এই বইটির সম্পর্কে তালিবানের বিরূপ প্রতিক্রিয়াই এক ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে আফগান বই বাজারে। ক্রমশ কমতে থাকে বইয়ের বিক্রি। যেখানে প্রতিটি দোকানে একটা সময় দিনে গড়ে ৫০টির মতো বইয়ের কেনাবেচা হত, এখন সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে শূন্যের কাছাকাছি। পাঠক কিংবা ক্রেতার দেখা পাওয়াই দুষ্কর সেখানে। এখনও পর্যন্ত কোনো হিংসাত্মক ঘটনা না ঘটলেও, বইয়ের দোকানে মাঝেমধ্যে ঢুঁ মারছে চরমপন্থী তালিবান যোদ্ধারা। জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখছে ধর্মীয় বই নাকি রোম্যান্টিক গল্পের বই রাখা আছে বিপণীতে।

আরও পড়ুন
অবশেষে পর্তুগালে ঠাঁই পেলেন আফগান মহিলা ফুটবলাররা

এই ছবি শুধুমাত্র কাবুলের নয়। আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন গোটা আফগানিস্তানের বই ব্যবসায়ীরা। আকস্মিকভাবে বইয়ের বিক্রি কমায় আর্থিকভাবে বিপন্ন তাঁরা। ধাক্কা খেয়েছেন আফগানিস্তানের ছোটো স্থানীয় প্রকাশনা সংস্থাগুলিও। ‘সাদাত’, ‘দ্য বুকসেলার অফ কাবুল’, ‘শাহ এম বুক কোম্পানি’-র মতো খ্যাতনামা স্টলগুলির দরজা নিয়মিত খুললেও, ঝিম ধরা আবহাওয়া সেখানে। 

ক্ষমতায় আসার আগে তালিবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আগের মতো আক্রমণাত্মক থাকবে না তারা। নাক গলাবে না সাধারণের ব্যক্তি স্বাধীনতায়। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, খোলাশ ছেড়ে যেন বেরিয়ে আসছে জেহাদি মনোভাব। একদিকে যেমন সমস্ত খেলাধুলো থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে মহিলাদের, তেমনই এখনও পর্যন্ত স্কুলে ফেরার অনুমতিও দেয়নি তালিবান সরকার। প্রকাশ্যে এসেছে শিল্পীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের দৃশ্যও। এবার কি সেই তালিকায় নবতম সংযোজন হতে চলেছে বই ব্যবসায়ীরা? সেই সম্ভাবনাই ক্রমশ প্রবল হচ্ছে দিনে দিনে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More