উৎসব, দুর্গাপুজো মানেই উপহারের মরশুম। আর ছোটো থেকে যে মানুষগুলোর কোলে-পিঠে বড়ো হয়ে ওঠা— নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর তাঁদের হাতে উপহার তুলে দেওয়া প্রত্যেকের কাছে স্বপ্নের মতোই। নতুন জামাকাপড়, ঘড়ি, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট— এসব তো চেনা পরিধির মধ্যেই। সমস্ত ছক ভেঙে এবার পুজোয় বৃদ্ধ বাবাকে আস্ত চায়ের দোকান (Tea Stall) উপহার দিলেন কলকাতার অভিনেত্রী বিনীতা গুহ (Binita Guha)।
না, কোনো বিলাসবহুল দোকান নয়। বরং, ছোট্ট নীল রঙের ঠেলা গাড়ি, মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি। বিস্ময় লাগছে নিশ্চয়ই? প্রশ্ন জাগছে, এমন উপহারের কারণ কী? সহজ কথায় বলতে গেলে স্বপ্নপূরণ। আবার আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে বাবার পাশে দাঁড়ানোও বটে। হ্যাঁ, লকডাউনের প্রসঙ্গ উঠতে বাধ্য এক্ষেত্রেও। বছর দেড়েক আগে পর্যন্তও একটি মাড়োয়ারি কম্পানিতে চাকরি করতেন অভিনেত্রীর বাবা সুখেন গুহ। আয় সামান্য হলেও, তাতে সংসার চলে যেত অনায়াসে। কিন্তু মহামারী এক ঝলকে বদলে দেয় গোটা পরিস্থিতিটা। সুখেনবাবু জানালেন, “লকডাউনে প্রায় আট মাস ঘরে বসে ছিলাম। তারপর লকডাউন শিথিল হতে যেদিন কাজে বেরতাম, শুধু সেদিনের টাকাটুকুই পেতাম। কিন্তু এইভাবে তো আর সংসার চলবে না। তাই বিকল্পের প্রয়োজন ছিল একটা।” বাবাকে সেই বিকল্পের পথ দেখাতেই অভিনব এই উদ্যোগ অভিনেত্রী বিনীতা গুহের।
যাদবপুরের শক্তিগড় মাঠের কাছে গেলেই ফুটপাথের ধারে দেখা মিলবে ছোট্ট দোকানটির। গত ১০ অক্টোবর অর্থাৎ পঞ্চমীর দিন থেকেই খুলে গেছে সুখেনবাবুর এই দোকান। চা-বিস্কুটের পাশাপাশি রয়েছে ঘুগনি-মুড়ি, কচুরিও। তবে শুধুমাত্র কি রোজগারের জন্যই বেছে নেওয়া এই পথ? ব্যবসার বিকল্প তো আর কম ছিল না। তবে চায়ের দোকানই কেন? আসলে এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্য একটি কারণও। সুখেনবাবুর কথায়, “যাদবপুর অঞ্চলে আমি যেখানে থাকি, তার চার-পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনো চায়ের দোকান নেই। বলতে গেলে এই এলাকায় বহু ছাত্রছাত্রীরা পেইং গেস্ট হিসাবে থাকে। মূলত বাইরেই টিফিন করে তারা। আর সেটার জন্য তাদের অনেকটা পথ যেতে হয়, এইট-বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে। সেখানে যদি তারা কাছাকাছি পায় টিফিনটা, সেই কথা ভেবেই চায়ের দোকান করার চিন্তাভাবনা। তাছাড়াও আমার ছোটো থেকেই স্বপ্ন ছিল একটা চায়ের দোকানের।”
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (পাঁচ)
হ্যাঁ, বাঙালির সঙ্গে চায়ের দীর্ঘকালীন সম্পর্ককে অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো। বর্তমান প্রজন্ম সেই সংস্কৃতির থেকে অনেকটা সরে এলেও, তার ছাপ আজও সুস্পষ্ট সমাজের বুকে। পাশাপাশি এও সত্যি, রাস্তার গা-ঘেঁষা চায়ের দোকানকে হীন চোখে দেখেন অনেকেই। প্রশ্ন থেকে যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে এমন উদ্যোগের জন্য ঠিক কতটা সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে বিনীতাকে? উত্তর দিলেন স্বয়ং অভিনেত্রী, “এগুলো নিয়ে আলাদা করে আমি কিছু ভাবি না। আমি যদি রাস্তায় বসে ফুলও বিক্রি করি, সেটাও আমার কাছে সৎপথে উপার্জন। বরং, এই উদ্যোগটাকে মানুষ যেভাবে অ্যাপ্রিসিয়েট করেছেন, সেটা আমি আশাও করিনি। সন্তান হিসাবে দায়িত্ব থেকেই এই উদ্যোগটা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে করছি বলেই সেটা খারাপ, আর বড়ো সাজানো-গোছানো দোকান হলেই সেটা ভালো— এরকম নয় একেবারেই।”
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (চার)
বিনীতার এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাতে গেলেও হয়তো শব্দ কম পড়ে যায়। অভিভাবকদের পাশে দাঁড়ানো তো বটেই, পাশাপাশি বিনীতার এই উদ্যোগ যেন সিসিডি, ক্যাফেটেরিয়ার যুগে দাঁড়িয়েও উস্কে দিচ্ছে বাঙালির চিরন্তন নস্টালজিয়াকে, কলকাতার স্ট্রিটফুডের আমেজকে। অভিনব বললেও যাকে কম বলা হয় বোধ হয়…
আরও পড়ুন
চায়ের গল্প, নানা রকমের শ্রম ও জাতিনির্মাণ (তিন)
Powered by Froala Editor