মাধব আর আনোয়ার ছিল প্রথম ‘গুরু’, গানের সুরে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান শচীন কর্তা

তিনি ছিলেন ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন বিলাস-বৈভবের প্রাচুর্য। সাধারণ জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার এক অলিখিত নিয়ম ছিল রাজবাড়িতে। গুরুজনরা নজর রাখতেন যেন এই নিয়মের ব্যতিক্রম না হয়। তাঁর দমবন্ধ লাগত রাজতন্ত্রের এই যাঁতাকলের মধ্যে। বারবার পালিয়ে যেতেন মাটির কাছে। নদী-মাঠ-বুনো ঘাসের ঘ্রাণে খুঁজে পেতেন নিজেকে। যে মাটিতে জন্ম, কীভাবে অস্বীকার করবেন সেই মাটির টানকে? রাজকুমারের তকমা ছেড়ে মিশে যেতেন ওই ‘সাধারণ’-এর ভিড়ে। সেখান থেকে তুলে নিতেন সুর, ভাটি গাঙের ছন্দে মনের মধ্যে বেজে উঠত লোকগানের বোল। আর তাই শচীন দেববর্মণের (Sachin Dev Burman) গানে স্বাদ পাওয়া যায় মাটির আদরের। 

এই শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন পিতা নবদ্বীপচন্দ্র দেববর্মণের কাছে। চার বোন, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শচীনই সবচেয়ে ছোটো। ফলে বাকিদের তুলনায় ভালোবাসা যেমন বেশি পেয়েছেন, তেমনই তাঁকে কখনও দূরে পাঠাতে চাননি নবদ্বীপচন্দ্র। বাকি পুত্রসন্তানরা শান্তিনিকেতনে পড়তে গেলেও তাঁকে ভর্তি করা হয় আগরতলার ‘কুমার বোর্ডিং’-এ। রাজবংশের সন্তান বলে সেখানে আলাদা সম্মানের চোখে দেখা হত বালক শচীনকে। এমনকি গুরু অপরাধে লঘু দণ্ড দেওয়া হত তাঁকে। খবর পেয়ে আর দেরি করেননি নবদ্বীপচন্দ্র। এরকম শাসনবিহীন জীবনে তো ‘মানুষ’ হওয়া মুশকিল। তৎক্ষণাৎ নিয়ে এলেন নিজের কাছে। পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি চলল গানের তালিম। কুমিল্লার এক ধ্রুপদ ও খেয়াল গায়কের কাছে ভর্তিও করে দিতে চাইলেন শচীনকে। যদিও শেষ পর্যন্ত সফল হল না এই পরিকল্পনা।

কেন? কারণ, বালক শচীনের মন তখন পড়ে আছে ত্রিপুরার বিস্তীর্ণ অরণ্যপ্রকৃতির মধ্যে। ধ্রুপদ বা খেয়াল ভালো লাগত ঠিকই, তবে তার চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল গ্রামগঞ্জের ‘সাধারণ’-এর সুরে মিশে থাকা লোকসঙ্গীতের ব্যাকুলতা। উৎসব-অনুষ্ঠানে বাড়িতে প্রায়ই বসত বাউল-ভাটিয়ালির আসর। গাজন বা কালীনাচের গাইয়েরা বোল তুলত রাজবাড়িতে। অবাক বিস্ময়ে সেগুলিতে মুগ্ধ হয়ে থাকতেন তিনি। মাধব নামের এক বৃদ্ধ কর্মচারী ছিল তাঁদের। অনেক কাজের মধ্যে যার একটি কাজ ছিল, প্রতি রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ির সকল শিশু-কিশোরদের সুর করে রামায়ণ পড়ে শোনানো। সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা ছিল না তাঁর। অথচ, এক আশ্চর্য সাবলীল সুরেলা দুলুনিতে অভিভূত হয়ে থাকত সবাই। 

অবশ্য ছোটোবেলায় আরও একজন ‘গুরু’ ছিল তাঁর। গানের তো বটেই, সঙ্গে মাছ ধরার গুরু। তার নাম আনোয়ার। রাজবাড়ির কর্মচারী হলেও, শচীনের বন্ধু ও শিক্ষক। বাগানের বাঁশ কেটে, ছিপ তৈরি করে, এক পুরনো মরচে পড়া বঁড়শি দিয়ে চলত মাছ ধরার ‘ক্লাস’। রাজপরিবারের সন্তান জনৈক মুসলিম কর্মচারীর সঙ্গে ভরদুপুরে বসে মাছ চুরি শিখছে, দৃশ্যটি বোধহয় গুরুজনদের কাছে খুব একটা সম্মানজনক ছিল না। কিন্তু শচীন যেতেন অন্য কারণে। রাতের বেলা দোতারা বাজিয়ে গান ধরত আনোয়ার। ভরা পূর্ণিমার সর্বস্ব গ্রাস করা চাঁদের আলোতে দিঘির পারে বসে যখন আনোয়ার খোলা গলায় ভাটিয়ালি ধরত, তখন যেন দুনিয়াটা অন্যরকম মনে হত তাঁর। পার্থিব জগতের পরিধি ছেড়ে হারিয়ে যেতেন দূর কোনো গ্রহে। এই মাদকতা চলত রাত জুড়ে, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেও চলত মানসভ্রমণ। হুঁশ ফিরত পরদিন, স্কুলে ব্যাকরণ ভুল করলে। পরে তিনি লিখেছিলেন, “আনোয়ারের গানে সোজা সরল সুরে ও কথায় দেহতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব, রাধাকৃষ্ণের মিলন মিলন-বিরহ বর্ণনা কী যে অপূর্ব আমেজ এনে দিত, তা বুঝিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।” মাধব-আনোয়ারই ছিল শচীন কর্তার লোকসঙ্গীতের প্রথম ‘গুরু’।

আরও পড়ুন
ভালো লাগছে না মুম্বাই, সব ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা!

আর সেই শিক্ষার গুণেই রেহাই পেয়েছিলেন এক মজার বিপদ থেকে। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। কুমিল্লা থেকে দশ মাইল দূরে কমলাসাগর পূজার মেলা দেখতে গেছেন বন্ধুদের সঙ্গে। বাড়িতে বলেননি কাউকে, ভেবেছিলেন ফিরতে পারবেন সন্ধ্যার মধ্যেই। মেলা শেষে ফেরার পথে দেখেন ট্রেন প্রায় স্টেশন ছাড়ার মুখে। বিনা টিকিটেই উঠে পড়লেন সদলবলে। ব্যাস, কুমিল্লায় নামতেই বন্দি হতে হল স্টেশনমাস্টারের হাতে। এদিকে রাত হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরতে না পারলে কী হবে নিজেই জানেন না। অবশ্য বুদ্ধি দিল এক বন্ধু। স্টেশনমাস্টারের মা গান ভালোবাসেন, বিশেষত ভাটিয়ালি আর ঢপ-কীর্তন। ভয় আর সংকোচ নিয়েই শুরু করলেন গান গাওয়া। দশ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত সেই ভদ্রমহিলা। এক কিশোর ‘বন্দি’-র কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে স্টেশনমাস্টারই ডেকে এনেছেন তাঁকে। মুক্তি তো মিললই, উপরি হিসেবে ছিল মিষ্টিমুখ।

আরও পড়ুন
মান্না দে-র হাতে দায়িত্ব দিয়ে, মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা!

গানের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল মুক্তির চাবি। বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে সেই সুরের জাদুতেই ভাসিয়েছেন সারা দেশকে। যদিও শিকড় জড়িয়ে ছিল দেশের মাটিতেই। সব ভুলে গেলেও, তিনি শেষ পর্যন্ত ভোলেন না মায়ের কোল। বাউল-ভাটিয়ালির সুরে বারবার সেখানেই ফিরে আসেন শচীন কর্তা।

ঋণস্বীকার : সরগমের নিখাদ, শচীন দেববর্মণ

Powered by Froala Editor