পা দিয়েছেন ৮৯ বছরে, নিজেই বৃদ্ধাশ্রম চালান কেরলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা

কর্মসূত্রে সন্তানসন্ততিরা সকলেই থাকেন বিদেশে। ২০০৪ সালে স্বামীকে হারানোর পর যেন আরও বেশি করে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করেছিল তাঁকে। সন্তানরা আমেরিকায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ঠিকই, তবে দেশ ছাড়তে রাজি হননি তিনি। বরং, স্থানীয় মহিলাদের উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নের জন্য শুরু করেন এক লড়াই। এর এক দশক পরে একক উদ্যোগেই খুলে ফেলেন এক আস্ত বৃদ্ধাশ্রম। 

কেরলের কোয়াট্টামের বাসিন্দা কারুসেরিল এন থানকাম্মার গল্প চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। বয়স ৮৯ বছর। তবে বার্ধক্যকে তুড়ি মেরেই সমাজে বদল আনার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একা হাতেই একটি আস্ত বৃদ্ধাশ্রম সামলাচ্ছেন কেরলের এনএসএস উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত হিন্দি শিক্ষিকা। 

শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গতা কাটাতেই অঞ্চলের প্রবীণদের দলে যোগ দেন তিনি। প্রতিদিন সকালে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে পড়তেন তাঁদের সঙ্গে। সে-সময়ই তাঁর নজর কাড়ে বিষয়টি। তাঁর মতো বহু প্রবীণ-প্রবীণাকেই একা থাকতে হয় নিজের বাড়িতে। একাকীত্ব দূর করতে তাঁদের মধ্যে সংবাদপত্র এবং বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন তিনি। পাশাপাশি শরীর সুস্থ রাখতে যোগাসন অনুশীলন করার জন্যও বাকিদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন প্রাক্তন শিক্ষিকা। আবার যাঁরা লেখাপড়া জানেন না, রীতিমতো তাঁদের ক্লাস নেওয়া শুরু করেন তিনি। 

পরবর্তীতে থানকাম্মার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল আর্থিক স্বচ্ছলতার বিষয়টিও। লক্ষাধিক টাকার বেতন পেলেও, অনেকেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের পরিচর্যার জন্য ন্যূনতম আর্থিক সাহায্যটুকুও পাঠান না অনেকে। থানকাম্মার কথায়, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই মানবিক অবক্ষয় বেড়ে চলেছে ক্রমশ। না, এই রূঢ় বাস্তব দেখে চুপ করে থাকেননি তিনি। নিজের ২০০ বছরের পুরনো পৈতৃক বাড়িকেই বদলে ফেলেছিলেন বৃদ্ধাশ্রমে। 

সেটা ২০১৭ সালে। উদ্বোধন হয়েছিল ‘মানবোদয় পাকালভেদু’-খ্যাত এই কেয়ার সেন্টারের। শুরুতে তাঁর এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন মাত্র ৫ জন। আজ সংখ্যাটা বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ৩০-এ। শুধু আশ্রয়দানই নয়, প্রবীণ-প্রবীণাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতেও শিখিয়েছেন ৮৯ বছরের শিক্ষিকা। ধূপকাঠি, মোমবাতি, কাগজের ব্যাগ কিংবা ডিটারজেন্ট তৈরির মতো হাতের কাজে পারদর্শী এই হোমের সকলেই। কেউ আবার করেন প্যাকেজিং-এর কাজ। তাঁদের সকলকে নিয়েই যেন গড়ে উঠেছে আস্ত এক পরিবার। সেখানে শূন্যস্থান নেই কোনো। নাম-গন্ধ নেই সঙ্গীহীনতারও। 

আশ্রমবাসীদের সম্মিলিত উপার্জনের টাকাতেই চলে আশ্রমের বিদ্যুৎ খরচা, টেলিভিশন কিংবা টেলিফোনের বিল। তবে ‘সঙ্গী’-দের খাওয়া-দাওয়ার খরচ চালান থানকাম্মা নিজেই। তাঁদের চিকিৎসার জন্যও গড়ে তুলেছেন একটি বিশেষ তহবিল। বিদেশ থেকে থানকাম্মার তিন সন্তান নিয়মিত অর্থ পাঠান এই তহবিলে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, নব্বই-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও নিজেই আশ্রমের সমস্ত কাজ দেখাশোনা করেন তিনি। এমনকি তাঁর অবর্তমানে এই আশ্রম যাতে বিনা-বাধায় চলতে পারে, সেই পরিকল্পনাও করে রেখেছেন প্রাক্তন শিক্ষিকা। সমাজে বদল আনতে তাঁর এই মানবিক উদ্যোগ কুর্নিশযোগ্যই বটে… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More