সাঁতার কাটতে পারে না শুক্রাণু, তিনশো বছরের ভুল ধারণা ভাঙল থ্রি-ডি মাইক্রোস্কোপ

পদার্থবিদ্যা হোক কিংবা রসায়ন— যুগে যুগে বিবর্তন হয়েছে বিজ্ঞানের। যত উন্নত হয়েছে প্রযুক্তি, একটি তত্ত্বকে বাতিল করেই উঠে এসেছে নতুন তত্ত্ব। ঠিক সেইভাবেই সম্প্রতি প্রায় তিনশো বছরের ভুল ভেঙে দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এতদিন পর্যন্ত মনে করা হত, শুক্রাণু অনেকটা ইল মাছের মতোই সাঁতার কেটে ডিম্বাণুর সন্ধানে পাড়ি দেয় দীর্ঘ পথ। দু’পাশে লেজ নাড়িয়ে সৃষ্টি করে গতিশীলতার। তবে বাস্তবে যে একেবারেই ঘটে না এমনটা, তা গতবছর লকডাউন চলাকালীন সময়েই প্রকাশ্যে আনেন বিজ্ঞানীরা। নেপথ্যে সেই প্রযুক্তিই।

তবে আজও যদি মাইক্রোসোপে চোখ রাখা যায়, তবে দেখা যাবে শুক্রাণুরা সাঁতার কেটেই এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। তবে ভুল হয় কীভাবে এই তত্ত্ব? আসলে এই জায়গাতেই রয়ে গেছে এক রহস্য। যার শুরু হয়েছিল আজ থেকে তিনশো বছরেরও বেশি সময় আগে। সপ্তাদশ শতাব্দীর শেষের দিকের কথা। প্রথম অণুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে শুক্রাণুদের উপস্থিতি এবং চরিত্রকে তুলে ধরেছিলেন বিজ্ঞানী অ্যান্টোনি ভন লিউয়েনহক।

সেই অণুবীক্ষণ বা মাইক্রোস্কোপেই স্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে শুক্রাণুদের। দেখা যায় তাদের সাঁতার কাটার প্রক্রিয়াও। পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছিল কেমোঅ্যাট্রাকট্যান্ট নামক একটি জৈব রাসায়নিকের প্রভাবেই তারা পাড়ি দিতে সক্ষম হয় এভারেস্টের সমান পথ। তবে ‘ভাঁওতা’ দিয়েছিল লিউয়েনহকের তৈরি ঐতিহাসিক যন্ত্র মাইক্রোস্কোপ-ই।

বিষয়টা ঠিক কেমন? সপ্তদশ শতকে তৈরি সেই মাইক্রোস্কোপে দেখা যায় মূলত ছিল দ্বিমাত্রিক ছবি। আজও যা ব্যবহৃত হয়ে আসছে বিশ্বের অধিকাংশ ল্যাবরেটরিতেই। আর দ্বিমাত্রিক প্রতিচ্ছবির মধ্যেই এতদিন লুকিয়ে ছিল সেই ধাঁধাঁ। মেক্সিকোর ন্যাশনাল অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গত আগস্ট মাসে সমাধান করেন সেই সমস্যার। দোসর থ্রি-ডি মাইক্রোস্কোপ। সেইসঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ৫৫ হাজার ছবি তোলায় সক্ষম ক্যামেরার সাহায্যে রহস্যোন্মোচন করেন তাঁরা।

ছবিগুলিকে পর পর সাজিয়ে ভিডিয়োর ফর্ম্যাটে সাজাতেই প্রকাশ্যে আসে আসল ঘটনা। পারতপক্ষে পুরো শুক্রাণুটিই লেজ-সহ আবর্তিত হয়ে থাকে ৩৬০ ডিগ্রি। তবে এখানেও খানিকটা জটিলতা রয়েছে। লেজটির ঘূর্ণন হয় গতিপথকে অক্ষ করে তার চারিদিকে। অন্যদিকে শুক্রাণুর মূল দেহটি আবর্তিত হয় অক্ষ-বরাবর। ধরা যাক কোনো ঘূর্ণায়মান বুলেট এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এবার সেই বুলেটের কোনো কোনো বাঁকানো সুতো জুড়ে দিলে যেমনটা হবে, অনেকটা সেকরমই। তবে এক্ষেত্রে গতিপথের অভিমুখ বারবার বদলের জন্য এই সমগ্র সিস্টেমটাই পাক খেতে থাকে লাট্টুর মতো। 

এই ঘটনাটিকেই লিউয়েনহক দেখেছিলেন দ্বিমাত্রিক তলে। আর যার ফলে অভিক্ষেপের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল ডানদিক-বাঁদিকে শুক্রাণুর সাঁতার কাটার ছবি। তবে থ্রি-ডি মাইক্রোস্কোপ শুধু এই বায়োলজিক্যাল ধাঁধাঁরই সমাধান করেনি। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছে গণিতকেও। অপ্রতিসম গতির মধ্যেও প্রতিসমতার প্রমাণ এই ঘটনা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে? 

আরও পড়ুন
একমাত্র বাঙালি শিশু বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানমেলায় বীরভূমের অনিরুদ্ধ

Powered by Froala Editor