সংকটে রাজ্যের অধিকাংশ জলাভূমি, হারাচ্ছে বাস্তুতন্ত্রও; আশঙ্কিত পরিবেশকর্মীরা

“রাজা আসে যায়/ রাজা বদলায়/ দিন বদলায় না…”। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটাই যেন ফলে যায় হরফে হরফে। আজ ২ ফেব্রুয়ারি। আবার ক্যালেন্ডারের পাতায় এসে হাজির ‘বিশ্ব জলাভূমি দিবস’। খাতায়-কলমে রাজ্য কিংবা দেশ বা আন্তর্জাতিক স্তরে দিনটি পালিত হলেও, বাস্তবে তার ছাপ পড়েনি এতটুকুও। উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে জলাভূমি ধ্বংসের কর্মযজ্ঞ।

অথচ জলাভূমির ওপর নির্ভর করেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র। যা বজায় রাখে পরিবেশের ভারসাম্য। মাছ, পাখি, সরীসৃপ এবং বিভিন্ন প্রজাতির পতঙ্গ ও অণুজীবের মূল আবাসস্থল এই জলাভূমিই। যারা প্রত্যেকেই আন্তর্সংযুক্ত একে-ওপরের সঙ্গে। দ্রুত জলাভূমির হারিয়ে যাওয়া ভাঙছে সেই জৈবিক চক্রকে।

“বাঘরোল, ভোঁদড় এই ধরণের প্রাণীগুলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এদের উপস্থিতিই নির্দেশ দিত মাছ, পোকামাকড়, জলজ উদ্ভিদের পরিমাণকে। এদের সংখ্যা কমে যাওয়া দেখিয়ে দিচ্ছে সেই সিস্টেমটাই ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে। সংঘাত বাড়ছে মানুষের সঙ্গে। এবং আমরা বর্তমানে ষষ্ঠ গণ-অবলুপ্তির মধ্যেই রয়েছি। ফলে একটা বড় জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যেতে পারে জলাভূমি ধ্বংসের কারণে”, বলছিলেন জলাভূমি গবেষক তিয়াসা আঢ্য। রাজ্যপ্রাণী বাঘরোলের ওপরে বিস্তারিত গবেষণা রয়েছে তাঁর। জলাভূমি নির্ভর এই প্রাণীটির অস্তিত্বও যে বেশ সংকটে তা জানালেন তিনি। জলাভূমি দিবসকে মাথায় রেখেই এই ফেব্রুয়ারি মাসটি পালিত হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক বাঘরোল মাস’ হিসাবে। কিন্তু এরপরেও সচেতনতা ফিরে আসছে মানুষের মধ্যে? বিক্ষিপ্তভাবে বাঘরোল হত্যার ঘটনা হামেশাই চোখে পড়ছে রাজ্যজুড়েই।

পরিবেশকর্মী তিস্তা দাসের কথাতেও উঠে এল জনসচেতনতার কথাই, “জলাভূমি বুঝিয়ে প্রায় সর্বত্রই চলছে নির্মাণ কার্য। আদতে তাতে সভ্যতা এতটুকুও এগিয়ে যাচ্ছে না। সেই প্রাণীগুলো তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই, সেইসঙ্গে তার প্রভাব পড়ছে আমাদের ওপরেও। আমার মনে হয় শুধু আইন দিয়ে এটা বন্ধ করা যাবে না। এটা বোঝাতে হবে মানুষকে। আরও বেশি করে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে মানুষকে বোঝানোর জন্য। প্রশাসনিকভাবে খাতায় কলমে সবকিছুর ব্যবস্থা থাকলেও, সরকারি স্তরে কতটা সেই উদ্যোগ নেওয়া হয় তা আর নতুন করে বলার নেই।”

আরও পড়ুন
হিমাচলের জলাভূমিতে অসংখ্য পরিযায়ী পাখির রহস্যমৃত্যু, কারণ অজানা বিশেষজ্ঞদের

তবে শুধু গাফিলতিই নয়, সাংবিধানিক স্তরেও রয়েছে জটিলতা। মূলত যে জলাভূমির ওপরে নির্মাণ নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সেই মাসল্যান্ড বা জলাভূমিগুলিকেই চিহ্নিত করা আছে পতিত জমি হিসাবে। কিন্তু আদৌ কি তা পতিত জমি? কারণ সমান্তরালভাবে দেশের আইনি মানচিত্রে সেটি রয়েছে জলাভূমি হিসাবে। আইনত যেখানে নির্মাণ প্রকল্প অবৈধ। অর্থাৎ, একই সঙ্গে দু’রকম পলিসি বলছে দু’রকম কথা। অন্যদিকে এই জটিলতার মধ্যে দ্রুত হারে কমছে জলাভূমির পরিমাণ।

শিল্পযুগের আগে যে পরিমাণ জলাভূমি ছিল তার ৮৭ শতাংশই মুছে গেছে পৃথিবী থেকে। আন্তর্জাতিক স্তরে না গিয়ে দেখা যাক শুধু কলকাতার দিকেই। যাদবপুরের গবেষক মুকুল রায়ের গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘ফাইভ থাউসেন্ট মিররস’ থেকে জানা যায়, গত দুই দশকে কলকাতার জলাশয়ের সংখ্যা ৮৬০০ থেকে হ্রাস পেয়েছে ৪৬ শতাংশে। এমনকি জিপিএস ম্যাপিংয়েও ধরা পড়ছে, ক্রমশ কংক্রিটে মুড়ে যাচ্ছে শহরের জলাশয় ও জলাভূমিগুলি।

আরও পড়ুন
জলাভূমি বুজিয়ে তৈরি হবে গলফ কোর্ট, আদালতের দ্বারস্থ মুম্বাই-এর প্রৌঢ় দম্পতি

তবে যেটুকু অবশিষ্ট আছে সেগুলির স্বাস্থ্যও যে খুব ভালো, তেমনটা একেবারেই নয়। “আমরা গত ৮ মাসে কলকাতার ১১৩টি জলাশয়ের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিলাম। যার মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশ জলাশয়ের এখনও পর্যন্ত সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বাকিগুলো প্রায় বুজে গেছে বা দূষিত হয়েছে কোনোভাবে। অনেকক্ষেত্রে জলাশয় থাকলেও তা ঘিরে দেওয়া হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। সেটা তো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। তার চারিদিকে মাটি, গাছ না থাকলে ওয়াটারবডি বা ওয়েটল্যান্ডটা ব্রিড করার সুযোগই পাবে না। আর প্লাস্টিক এবং অন্যান্য আবর্জনা নির্দ্বিধায় ফেলা হচ্ছে পুকুর এবং নালা, ড্রেনেজ সিস্টেমগুলিতে। সেটাও তো বিরাট ক্ষতি করছে পরিবেশের”, জানালেন ‘জলাদর্শ’ বেসরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সায়ন্তনী দত্ত। 

ধীরে ধীরে এই বাস্তুতন্ত্র মুছে যাচ্ছে তাতে তো সন্দেহ নেই কোনো। কিন্তু কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই জলাভূমিগুলির অস্তিত্ব? প্রথমত শুধু পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দিকে যদি লক্ষ্য করা যায়, তব দেখা যাবে এই গোটা ভূ-ভাগটাই গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকা। ফলে একদিকে যেমন খরস্রোতা নদী বয়ে নিয়ে আসছে পলিমাটি, তেমনই দক্ষিণের সমুদ্র থেকে ক্রমশ ঢুকছে লবণাক্ত জল। বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশই নজর টানলেন সেইদিকেই। জলাভূমিগুলি নদী, নালার সঙ্গে সংযুক্ত থাকার কারণেই সেই পলি এবং লবণ শোষণ করে চলেছে। ফলে চাষাবাদ সম্ভব হচ্ছে দুই বাংলাতেই। 

চলতি বছরে বিশ্ব জলাভূমি দিবসের বিষয়বস্তু ‘জল’। নল, হোগলা, উলুখাগড়া কিংবা ম্যানগ্রোভ অরণ্য থাকার কারণে প্রাকৃতিকভাবে হয়ে চলেছে জল পরিশোধনের প্রক্রিয়াটাই। লোহা, আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতুগুলিকে শোষণ করে হোগলা বন। তাদের হারিয়ে যাওয়া বাড়িয়ে তুলছে দূষণের মাত্রাকেও। “ওয়াটার পিউরিফিকেশনের অনেকটাই কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে করে দিচ্ছে জলাভূমিগুলি। এটা যদি না থাকত কয়েকশো কোটি টাকা লাগত কলকাতার জলকে পরিশুদ্ধ করতে। এবং এই জল কিন্তু পানীয় জল বা ভূগর্ভস্থ জল নয়, সেটা মাথায় রাখতে হবে”, জানালেন পরিবেশকর্মী এবং অ্যানিম্যাল অ্যাক্টিভিস্ট শুভ্রজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়।

দ্বিতীয়ত, কার্বন শোষণের অন্যতম হাতিয়ার এই বাদাবন। তাদের হারিয়ে যাওয়া প্রশস্ত করছে বিশ্ব উষ্ণায়নের পথ। দরজা খুলে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের। এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নিরিখে কলকাতা বিশ্বের মধ্যে রয়েছে সপ্তম স্থানে। পরিস্থিতি যে কতটা আশঙ্কাজনক তা থেকেই বোঝা যায়। 

তবে এখানেই শেষ নয়। জলাভূমি ধ্বংসের ফলে বেড়ে যাচ্ছে বন্যাও। বর্ষার সময় বাড়তি জল ধারণের জন্য অবশিষ্ট থাকছে কোনো অঞ্চলই। ফলে রাজ্যজুড়েই বাড়ছে প্লাবনের আশঙ্কা। ভুলে যাওয়া হচ্ছে দক্ষিণের বাদাবন না থাকলে ঝড়, সাইক্লোনগুলির প্রভাব এবং তাদের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যেত বাংলার ওপরে।

তবে এর মধ্যেও সামান্য আশার আলো জ্বালিয়ে রাখলেন রাজ্যের মুখ্য বন্যপ্রাণ আধিকারিক বিনোদ যাদব। জানালেন, জলাভূমি এবং নদীগুলির সংরক্ষণের ওপরে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে চলতি বছরে। সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেনিং ছাড়াও টাইগার রিজার্ভ অঞ্চলে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছে একটি প্লাস্টিক ড্রাইভ প্রোগ্রামের। তাছাড়াও আজ বিশ্ব জলাভূমি দিবস উপলক্ষে প্রকাশ করা হয় পাখি সুমারির ফলাফল। খানিকটা হলেও স্বস্তির আশ্বাস দিচ্ছে সেই সুমারি। সুন্দরবনে ব্ল্যাক নেকড গ্রিব এবং গ্রেট নট প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছেন তিনি।

তবে এই উদ্যোগগুলিকে কতটা সাদরে গ্রহণ করতে পারবে সাধারণ মানুষ, এখন সেটাই দেখার। দেখার, কতটা দৈনন্দিন জীবনে সচেতন হয়ে মানুষ হয়ে উঠতে পারে এই বৃহত্তর প্রকল্পের অংশ। নাহলে চলে যাবে আরও একটা বিশ্ব জলাভূমি দিবস। দু’-একদিন গমগম করেই আবার থিতিয়ে পড়বে ‘পরিবেশ বাঁচাও’-এর স্বর। আর আরও খানিকটা তাকে ঠেলে দেওয়া হবে মৃত্যুর দিকে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More