মৃত্যুর আগের দিন ছুটে গিয়েছিলেন পরিবারের কাছে, বিপ্লবী বাদল গুপ্তকে নিয়ে লিখলেন তাঁর ভাগ্নে

স্বদেশি আন্দোলন তখন স্তিমিত হয়ে এসেছে। গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি নতুন করে গড়ে উঠছে বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা। ১৯৩০ সাল, ৮ ডিসেম্বর। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংএ চত্বরে ঢুকে পড়েন মেজর বিনয় বসু, লেফট্যানেন্ট বাদল গুপ্ত এবং ক্যাপ্টেন দীনেশ গুপ্ত। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া তিন বিপ্লবীর দুঃসাহসী অভিযানে চমকে উঠেছিল সারা দেশ। তারপর প্রায় নব্বই বছর কেটে গেছে। মধ্য কলকাতায় একটি বাগান বাদ দিয়ে, তাঁদের আর মনে রাখেন না কেউই। এর মধ্যে চলে গেছে বাদল গুপ্তর জন্মশতবার্ষিকী। কজনই বা মনে রেখেছেন সেসব কথা? এবছর সেই বিস্মৃত বিপ্লবী বাদল গুপ্তকেই বাঙালির কাছে নতুন করে হাজির করলেন বিপ্লবীর ভাগ্নে বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত। বইমেলায় সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই, 'আমার মামা বাদল গুপ্ত'।

বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার দলের তিন তরুণ সদস্য তখন রাইটার্স বিল্ডিং-এর দিকে যাওয়ার জন্য তৈরি। রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের দিন ঠিক হয়েছে ৮ ডিসেম্বর। দিন পাঁচেক আগে 'হাইড আউট'এ চলে গেছেন তিনজনেই। আর হাইড আউট মানেই পরিবারের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ নেই। কিন্তু কতই বা বয়স তিনজনের? আর বাদল গুপ্ত তো সবচেয়ে ছোটো। সদ্য আঠেরোয় পা দিয়েছে। বাড়ির জন্য মন খারাপ তো করবেই। অভিযানের আগের দিন, অর্থাৎ ৭ ডিসেম্বর ছেলেবেলার শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিং চত্বর ঘুরে দেখতে যাযন বাদল গুপ্ত। তখনই নিকুঞ্জ সেনকে অনুরোধ করেন, একবার যদি কাকামণি তরণীনাথ গুপ্তের বাড়ি দেখা করা যায়। দলের কঠোর নিয়ম এড়িয়ে বাদলকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিকুঞ্জ সেন। পথে ছোটো বোন মৃদুলার জন্য কিনলেন চিনামাটির একটি পুতুল। পরিবারের স্মৃতি হয়ে থেকে গেছে সেই পুতুল।

ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃষ্টান্ত কিন্তু বাদলের পরিবারে প্রথম নয়। এর আগে তরণীনাথের দুই ভাই ধরণীনাথ ও নগেন্দ্রনাথ জড়িয়ে ছিলেন বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলায়। ১৩৪ নং হ্যারিসন রোডে দুই ভাইয়ের হোমিওপ্যাথি চেম্বার থেকে বোমা উদ্ধার করেছিল পুলিশ। সেই পরিবারের ছেলে বাদল। তাঁর শান্ত মুখের আড়ালে সবসময় লুকিয়ে থাকত শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করার জেদ। শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের উৎসাহে সেই জেদ দিনদিন বাড়তে থাকে। তারপর একদিন বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার দলের দুঃসাহসী রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের দায়িত্ব এসে পড়ে বাদলের উপর। পরিকল্পনা মতো রাইটার্স বিল্ডিং চত্বরে তিন ব্রিটিশ যুবকের ছদ্মবেশে ঢুকে পড়েন বিনয়, বাদল আর দীনেশ। সেখানে কর্নেল সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন তাঁরা। পুলিশ কমিশনার টেগার্টের বাহিনী ঘিরে ফেলে তিনজনকে। অকুস্থলে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন বাদল।

মা মৃদুলা গুপ্তের কাছে পরিবারের নানা কাহিনি শুনেছেন বিশ্বনাথবাবু। সেসব কথা শুনতে শুনতে শিশুমনের কল্পনায় পৌঁছে গেছেন অগ্নিযুগের সেই উত্তাল সময়ে। এসব কাহিনি ইতিহাসের দলিল হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। তবে তার থেকেও কাহিনিমূল্য বেশি। ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিস্পর্ধার কাহিনি সেসব।

আজ স্বাধীনতার সাত দশক পর দেশপ্রেমকে যখন ক্ষমতার ক্রীড়নক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন আবার নতুন করে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের দিকে ফিরে তাকানোর প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই মনে করছেন বিশ্বনাথবাবু। কোথায় সে দেশ? কোথায় তার মানচিত্র? যে দেশকে ভালোবেসে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা, সে দেশের পরিচয় আমরা আদৌ জানি তো?

More From Author See More