মাঝ আকাশে উড়ে গেল বিমানের ছাদ, তারপর?

ঝলমলে আবহাওয়া। টার্বুলেন্সের বালাই নেই কোনো। বিমানের জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বহু নিচে ভেসে বেড়াচ্ছে রাশি রাশি পেঁজা তুলো মেঘ। কেউ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করছেন এই দৃশ্য। কেউ আবার ডুব দিয়েছেন পানীয়ে, কেউ পড়ছেন পত্রিকা। এমন সময়ই কান ফাটানো শব্দ। আর তার পরেই চোখের নিমেষে উড়ে গেল বিমানের ছাদ (Roof)। যে বিমানসেবিকা পানীয় ঢেলে দিচ্ছিলেন যাত্রীদের গ্লাসে, তিনিও স্রেফ ভেসে গেলেন নীল আকাশে।

না, কোনো অ্যানিমেশন বা সিনেমার প্রেক্ষাপট নয়। তবে আজ থেকে ৩৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা হার মানাবে হলিউডের তাবড় অ্যাকশন মুভিদেরও। সাধারণত অধিকাংশ বিমান দুর্ঘটনাই ঘটে থাকে উত্তরণ কিংবা অবতরণের সময়। মাঝ আকাশে বিমানের ইঞ্জিন খারাপ হয়েছে কিংবা জ্বালানির ট্যাঙ্কে বিস্ফোরণ হয়েছে— এমন উদাহরণও পাওয়া যায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে। তবে উড্ডীন অবস্থায় বিমানের ছাদ উড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে কেবলমাত্র একবারই। সেদিক থেকে বিরল বললেও যেন কম বলা হয় এই আশ্চর্য দুর্ঘটনাকে।

শুরু থেকেই বলা যাক এই গল্প। দিনটা ছিল ১৯৮৮ সালের ২৮ এপ্রিল। হাওয়াই (Hawaii) দ্বীপপুঞ্জের হিলো থেকে হনুলুলুতে পাড়ি দিয়েছিল আলোহা এয়ারলাইন্সের (Aloha Airlines) ফ্লাইট-২৪৩ বিমানটি। মাত্র ৩৫ মিনিটের পথ। আকাশের অবস্থাও ছিল বেশ পরিষ্কার। ফলে নির্ধারিত সময়ে উড়ান নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি বিমানের। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই ২৪ হাজার ফুট উচ্চতায় পৌঁছে যায় ফ্লাইট-২৪৩। আর তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঘটে যায় বিপত্তি।

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা বেজে ৪৮ মিনিট। আকস্মিক বিস্ফোরণে ভেঙে যায় ককপিটের ঠিক পিছনের অংশের ছাদ। তাও সামান্য ফাটল নয়, চোখের নিমেষে দীর্ঘ ১০-১২ ফুট অংশের ছাদ বিচ্ছিন্ন হয়ে উড়ে যায় বিমান থেকে। বায়ু চাপের তারতম্যের কারণে সঙ্গে সঙ্গেই বিমান থেকে ছিটকে বেরিয়ে যান কর্মরত ৩৭ বছর বয়সি বিমান সেবিকা ক্ল্যারাবেল হো ল্যানসিং। সঙ্গে হু-হু করে বিমানের মধ্যে ঢুকে পড়ে -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস। সেইসঙ্গে অক্সিজেনের অভাবও প্রায় দমবন্ধ করে দিয়েছিল যাত্রীদের।

ঘটনাটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে, প্রাথমিকভাবে কিছুই বুঝতে পারেননি বিমানের নিয়ন্ত্রণে থাকা সহকারী চালক ম্যাডেলিন মিম টমকিনস। অন্যদিকে বিমানসেবিকাদের সঙ্গে যোগযোগ করতে ব্যর্থ হন ক্যাপ্টেন রবার্ট স্কর্নসথেইমার। কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে দ্রুত বিমানের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন উচ্চতা কমিয়ে জরুরি অবতরণের। তবে ততক্ষণ দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। ধীরে ধীরে ফাটল বাড়তে বাড়তে পৌঁছেছে প্রায় ১৮ ফুটে। ককপিট থেকে সামনের ডানার অগ্রভাগ পর্যন্ত গোটা অংশটিই তখন ছাদ ও দেওয়ালহীন। ভেঙে গেছে ককপিট এবং যাত্রী আসনের সংযোগস্থলে থাকা দরজাটিও।

পরবর্তী ১৩ মিনিট কেটেছিল রুদ্ধশ্বাসের মধ্যে দিয়ে। ক্যাপ্টেন রবার্টের একক দক্ষতায় যখন ফ্লাইট-২৪৩ মাউয়ি দ্বীপে অবতরণ করে, তখন বিকল হয়ে গেছে বিমানের দুটি ইঞ্জিনই। খারাপ হয়ে গেছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, একমাত্র ক্ল্যারাবেল ছাড়া সবমিলিয়ে ৮৯ জন যাত্রী এবং ৬ বিমানকর্মীর একজনও প্রাণ হারাননি এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায়। ৬৫ জন যাত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও, পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেন তাঁরা। বলতে গেলে এ এক অলৌকিক ঘটনাই বটে। কিন্তু কেমন এমন আশ্চর্য দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল বিমানটি?

বিমানটির প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘বোয়িং’ মার্কিন কোম্পানি হওয়ায়, এই ঘটনার তদন্তের ভার নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রই। আমেরিকার ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডের প্রকাশ করা নথিতে উঠে আসে, দীর্ঘদিন লবণাক্ত এবং আর্দ্র জলবায়ুতে কাজ করার ফলে মরচে ধরেছিল বিমানের ধাতব ছাদে। সেখান থেকেই তৈরি হয় লিক। সেখান থেকেই বাইরের দ্রুতগতি সম্পন্ন বাতাস বিমানে প্রবেশ করে নষ্ট করে দিয়েছিল বায়ুচাপের তারতম্য। চাপের এই আকস্মিক পরিবর্তনেই ভেঙে উড়ে যায় বিমানের ছাদের একটা বড়ো অংশ। তাছাড়াও অভিযোগ ওঠে বিমানটির রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও। বিমানের রাডার ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রের পরীক্ষা করা হলেও, ১৯ বছর বয়সি বিমানটির দীর্ঘদিন স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি বলেই অভিযোগ তুলেছিলেন তদন্তকারী আধিকারিকরা। আশ্চর্য এই ঘটনার পেরিয়ে গেছে ৩৫টি বছর। তবে সিভিল অ্যাভিয়েশনের দুনিয়ায় এ-ধরনের দ্বিতীয় কোনো ঘটনা ঘটেনি আজও। অন্যদিকে এত বছর পরও হাওয়াই ও হনুলুলতে ‘সেভিয়ার’ হিসাবেই পরিচিত ক্যাপ্টেন রবার্ট স্কর্নসথেইমার…

Powered by Froala Editor