আমার ছবিকে প্রভাবিত করেছে পিঙ্ক ফ্লয়েড, বিটলস, রবীন্দ্রনাথের গান

ফটোগ্রাফি আর পেইন্টিং-এর মধ্যে কি কোনো বিরোধ আছে আদৌ? ছবি তুলতে কীভাবে সাহায্য করে সাহিত্য? রাজনীতিই বা একজন শিল্পীর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এমনই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বললেন শুভময় মিত্র। সাক্ষাৎকার নিলেন অরিত্র দত্ত।

 আপনি হঠাৎ ফটোগ্রাফিতে আগ্রহী হলেন কীভাবে?

বাবার কাছে একটা ক্যামেরা ছিল, সেটা খুব বেশি পছন্দের ছিল না। পরে যখন মাধ্যমিক দিচ্ছি, তারপরেই ঠাকুমা আগফার একটা ক্যামেরা কিনে দেন, সেটাতেই চলত ছবি তোলা।তারপর, ফিল্ম থেকে ডিজিটালে জার্নি। এখন তো ডিজিটালেই ছবি তোলা হয়। কারণ ফিল্মের অসম্ভব ঝক্কি। সেখানে ডিজিটাল খুব ভালো কাজ করে।

আরও পড়ুন
এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন - সাত্যকি ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার

ছোট থেকে বাড়িতে সবার ছবি তুলতেন আমার কাকা, মূলত তাঁর ছবি দেখতাম। তারপর মেজদার তোলা ছবি দেখতাম। বড় হওয়ার পর ছবি দেখা শুরু করলাম। আমি ট্রেক করতাম এবং সেখানে ছবি তোলা। সেটা থেকেই টুকটাক নাম। এখন বুঝতে পারি, আমি যা তুলেছি এতদিন, এসবই হল তুমি কী দেখনি আর আমি কী দেখলাম – এই-ই। তারপর থেকেই কম্পোজিশান নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়। তিনজনের ছবি আমার মধ্যে প্রচুর প্রভাব ফেলে – শিবনাথ বসু, বিকাশ দাস এবং সন্তোষ রাজগরিয়া। এঁদের উপস্থিতি যা শিখিয়েছে তা বলার সাধ্য নেই আমার।

শুধু কি ফটোগ্রাফি? সঙ্গীত ও সুরও তো আপনাকে ছবি তোলায় প্রভাবিত করেছে...

ঠিকই। আমার ছবিতে পিঙ্ক ফ্লয়েডের প্রভাব অত্যন্ত বেশিভাবে পড়েছে। শুধু তাই কেন! বিটলস, রোলিং স্টোন এরাও আছে। কিন্তু কোথাও গিয়ে পিঙ্ক ফ্লয়েড ভয়ঙ্করভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। আমি যদি সঙ্গীত বা সুরকে বাদও রাখি, তবুও মানুষের মনের গহীন রহস্য বা না বলতে পারা অনেক যন্ত্রণা ব্যক্ত করে কথা। সত্যি বলতে, কীভাবে বা কোন প্রসেসে একটা ভালো গান বা শিল্প তৈরি হবে তার কোনো রেসিপি নেই। কিন্তু তাও তাদের কিছু সুর, কথা মিলে এমন কিছু তৈরি করেছে, যার জন্য আমরা এখনও আলোচনা করছি। যেমন আসা যাক ভিনাইল বা রেকর্ড কভারে। রেকর্ড কভার সাজানোর জন্য ভিস্যুয়াল ব্যাপারটাও খুব দরকারি। এরপর এল ক্যাসেটের যুগ, সেখানে ছবি গেল কমে। তারপর সিডি, সেখানে আরও কম। এখন পেন ড্রাইভে গান ঘুরছে। ফলে মিউজিকের সঙ্গে যে আর্ট, সেটা কমে গেল। এখন সেটা ভিডিও বানিয়ে নিচ্ছে কিন্তু স্ট্যাটিক আর্ট বলে আর কিছু নেই। সেই জায়গাটা খুব ক্ষতি হয়ে গেছে।

রাজনীতি হল একটা এক্সপ্রেশান। একটা ইতিহাস, সমাজ সবকিছু মিলিয়ে তার একটা প্রকাশ।

একবার আমি কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে দশ টাকার বিনিময়ে একটা বই কিনি, কারণ দেখতে পেয়েছিলাম তাতে প্রচুর ছবি। বইটা কাদের জানো? ফ্লয়েডের সমস্ত কাজ যারা করত, তাদের – ‘হিপনোসিস’। বইটার নাম ছিল ‘গুড বাই লুক’। আমি যদিও তখন না বুঝেই কিনেছিলাম বইটা। কিন্তু সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়াল।

ছবি তোলার পাশাপাশি তার এডিটিং-ও কি সমান গুরুত্বপূর্ণ? একটা ছবিতে রঙের গুরুত্ব নিয়ে আপনার মত কী?

আমি এডিটে বেশি সময় দিই না। আমার ছবিতে যা রং যেখানে থাকবার কথা, সেখানেই থাকে। আমি খুব অলস, আমি কিছুতেই অত বেশি সময় ছবি তোলার পর দিতে পছন্দ করি না। আমি তার বদলে যা করার, তা ক্যামেরাতেই করি। আমার একটা জোর হল, আমি এক্সপোজার খুব তাড়াতাড়ি সেট করতে পারি। এখনকার যে ক্যামেরা, তা সাধারণের থেকে একটু বেশি রং ধরে নেয়। অনেকে ঝকঝকে ছবি চান। কিন্তু কথা হল, যত বেশি রং থাকবে না, তত তুমি কম দেখবে! আজকের ছবিতে রঙের একটা প্রসঙ্গ থাকে। সেটুকুই ঠিক আছে। আমার ইচ্ছা হলেই সাদা-কালোয় খেলতে পারি। কিন্তু যেখানে রঙের প্রয়োজন, তার প্রসঙ্গও আমাকে মাথায় রাখতে হবে।

 প্রথম থেকেই কিন্তু আঁকার লোক এবং ক্যামেরার লোকের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে

ফটোগ্রাফি এবং পেইন্টিং – এই দুই-এর মধ্যে কি কোনো বিরোধ আছে? শিল্পমাধ্যম হিসেবে আপনার কাছে এ-দুটি ঠিক কেমন?

লোকে কিন্তু ছবি আঁকাটাকেই বেশি পাত্তা দিয়েছে। সেখানে ফটোগ্রাফির ইতিহাস খুব কম। কলকাতায় এখন আগের থেকে অনেক বেশি মানুষ ছবি তুলছেন, সেটা ভালোই। এতদিন অনেক ইনফিরিওর প্রিন্ট আমরা দেখতাম, এখন কিন্তু প্রিন্ট অত্যন্ত ভালো হয়। তাতে এমন ঝকঝকে রং যে মানুষের ইলিউশান তৈরি হচ্ছে, এটা কি ছবি না ফোটোগ্রাফ? যখন প্রথম ফোটোগ্রাফি আসে, তখন থেকেই কিন্তু ছবি আঁকিয়েরা খেপে গেলেন, কারণ তাঁদের জীবিকা মার যেতে পারে। ফলে সেটাকে জাদুবাক্স বা কালো জাদু বলেও চালানো হয়েছিল। প্রথম থেকেই কিন্তু আঁকার লোক এবং ক্যামেরার লোকের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। পাশাপাশি, ফটোগ্রাফিও প্রথম থেকেই পেইন্টিং-এর বিভিন্ন জিনিস ধরছে এবং নিজেদের ফর্মে ঢোকাচ্ছে। এবং এটাও মাথায় রাখতে হবে, ফটোগ্রাফার বা পেইন্টারদের কিন্তু এ-নিয়ে চেঁচামেচি নেই, এটা করে দালালরা। ফোটোগ্রাফ মানেই হল সেটা আবার তৈরি করা যাবে। আঁকা যাতেই হোক, সেটা কিন্তু ইউনিক। তার দাম তো থাকবেই। কেউ বলবে আমার কাছে চুয়াত্তরের একটা রামকিঙ্কর আছে। কেউ বলে শুনেছ, আমার কাছে একটা রঘু রাই আছে? কেউ বলবে না। তাই খামোকা লিমিটেড এডিশান লেখা। যাতে লোকে বোঝে এটাও একটা আর্ট, একটা ব্যাপার।

ক্যালভিনো আমাকে অসম্ভব প্রভাবিত করেন, দুরন্ত লেখা। ওঁর লেখা ইমেজধর্মী। বাংলায় একসময় বুদ্ধদেব গুহ। 

সাহিত্যের মধ্যে থেকে কীভাবে ছবি তোলার রসদ নেন আপনি?

আমি কী দেখাতে চাইছি, সাহিত্য অবশ্যই সেটাকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করে। প্রতিটা শব্দ একেকটা সিনেমা তৈরি করছে। ভালো সাহিত্যের গুণই হল সিনেমাটিক হওয়া। নিজে যা পড়ছ তখন তো চিত্রকল্প তোমার মাথার মধ্যেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে। অবশ্যই তাতে তোমার ভিসুয়াল সেন্স বাড়ছে। ছবি তোলার সময় সেটা  কাজে আসে। ক্যালভিনো আমাকে অসম্ভব প্রভাবিত করেন, দুরন্ত লেখা। ওঁর লেখা ইমেজধর্মী। বাংলায় একসময় বুদ্ধদেব গুহ। রবীন্দ্রনাথের কথা বলব না, তবে সঙ্গীত বললে, অবশ্যই। অসম্ভব ভাবে হ্যাঁ। কখন কী ছবি তুলতে হবে, সেটা উনি গানেই পথ দেখাচ্ছেন।
'ঘাসে ঘাসে খবর ছোটে
ধরা বুঝি শিউরে ওঠে'
এই গানটা সবাই তো শুনেছ, কী অসম্ভব ভিস্যুয়াল বল তো? গ্রাউন্ড লেভেল, একটা ক্যামেরা বিশাল একটা ক্যানভাস, সেখানে ঘাসগুলোর ওপর দিয়ে হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ধরা বুঝি শিউরে ওঠে মানে মাটি কাঁপছে বৃষ্টি হবে। আমি ভাবি, কীভাবে এমন ভয়ঙ্কর ভিস্যুয়াল উনি তৈরি করতে পারেন!

আচ্ছা একজন শিল্পী হিসেবে রাজনীতি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী? মানে, আপনার শিল্পী-সত্তা রাজনৈতিকভাবে কতটা সচেতন?

রাজনৈতিক চেতনা বলতে কী বোঝাবে? সিপিএম, বিজেপি নাকি অন্য কিছু! এথিকস? হ্যাঁ সেটা খুব সাধারণ, আমার যা ভালো লাগছে তা করব, যা লাগছে না তা করব না। যদি দেখি কোনোদিন সেই কাজের জন্য অন্য কাউকে ভুগতে হছে তবে সেটা করা যাবে না, যাই হয়ে যাক করা যাবেই না। আবার খুব মৌলিক জায়গায় ফিরে আসি। রাজনৈতিক মানে যদি রাজা-রাজড়া বল, সেটা কবেই শেষ হয়ে গেছে। তাদের নিয়মনীতি তো একই। আমি জঙ্গলমহলে গিয়ে থাকছি যখন, সেই ঘটনাগুলো দেখছি। সেগুলো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এবং আমি ছবি আঁকি সেখান থেকে। ‘পিকাবু’ সেটাই, সেখান থেকেই এর জন্ম। যদি বল আপনি কি শিল্পী সত্তাটা নিয়ে গেছিলেন? না, আমি একজন মানুষ হিসেবে গেছিলাম, যার ঘটনাগুলো দেখলে খারাপ লাগা উচিত। আমি ক্যামেরা নিয়েই যাইনি, যদিও নিয়ে যেতেই পারতাম। কিন্তু, আমি ওখানে ফটোগ্রাফার বা মানুষ হিসেবে গেছি। রাজনীতি হল একটা এক্সপ্রেশান। একটা ইতিহাস, সমাজ সবকিছু মিলিয়ে তার একটা প্রকাশ। আসল হচ্ছে পারসেপশান, যা দেখছি তা আসল না, কী বুঝছি সেটা আসল। সেটাই পলিটিক্স।

ছবির প্রসঙ্গ দিয়েই শেষ করি। একটা এগজিবিশনের সময় আপনার পরিকল্পনা কী থাকে? ছবির সজ্জার ক্ষেত্রে কোনো প্রস্তুতি নেন কি আগে?

একটা প্রদর্শনীর জন্য অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়। আমি যদি হুটহাট করে ছবি রেখে দিই, তাহলে কিন্তু সেটা একেবারেই মানাবে না। সেখানে যিনি দেখবেন, তাঁর একটা বিশাল ধাক্কা লাগবে। আমাকে আগে ঠিক করে নিতে হয় যে কটা ছবি থাকবে। এবারে হয়তো দেখা গেল তার অনেকগুলোই থাকবে না। তারপর যেখানে আমার প্রদর্শনী হচ্ছে, বাড়িতে ছোটো করে সেই জায়গাটার মডেল বানিয়ে নিই, তারপর ছবিগুলো ছোট ছোট করে প্রিন্ট করে সাজিয়ে দেখতে থাকি। আমাকে এটা মাথায় রাখতে হয়, দর্শক যখন একটা দেওয়াল ধরে দেখা শুরু করবেন তাতে কী কী দেখবেন এবং যদি উলটোভাবেও দেখেন তখনই বা কী দেখানো যেতে পারে। গোটাটাই একটা বিন্যাসের শিল্প, যাকে তুমি বলছিলে সজ্জা।