‘খড়ের চাল ফুঁড়ে, খাবারের প্লেটে এসে পড়ল পাকিস্তানি সেনার গুলি’


‘২৫ মার্চ, ১৯৭১। আমি তখন কোচবিহারের মাথাভাঙ্গা সাবডিভিশনের এক প্রত্যন্ত গ্রাম শীতলকুচিতে পোস্টেড। ওদিন রাতে যখন ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বিদ্রোহ ঘোষণা করল, পাকিস্তানি আর্মির একজন পাঞ্জাবি সুবেদার বর্ডারের অপর পার থেকে পালিয়ে এসে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাইল। রাত তখন সাড়ে বারোটা। আমাকে এক হাবিলদার ওয়ারলেসে জানালে, ওই পাঞ্জাবি সুবেদারের চোখ বেঁধে নিয়ে আসতে বললাম আমার কাছে। আমাদের কাছে তখন কোনো জেল ছিল না। ফলে লোকাল থানায় খবর দিলাম আমরা। থানার প্রিজনারস্‌ সেলে সেই রাতটুকু রইল পাকিস্তান আর্মির ওই সুবেদার। পরেরদিন সকালেই হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হল তাকে।’

বলছিলেন সমীর মিত্র। ভারতের বিএসএফের অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবশ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডান্ট ছিলেন তিনি। তখন বিএসএফের বয়স সাড়ে পাঁচ বছর। সমীরবাবুরও কর্মজীবন চার বছরের সামান্য বেশি। ভারত-পূর্ব পাকিস্তান বর্ডারে পোস্টিং থাকাকালীন, শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। প্রথমে ছিলেন ৭৫ নং ব্যাটেলিয়ানে, তারপর ৭৮ নং-এ। সে-সময়ের কথা বলতে গিয়ে স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠছে তাঁর চোখ। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের তরুণ বয়সে ফিরে যাচ্ছেন যেন তিনি –

‘এরপর, পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিফিউজি আসতে শুরু করল দলে দলে। আমাদের ওই অঞ্চলে কয়েক লক্ষ রিফিউজিকে রাখা হয়েছিল ক্যাম্প করে। শীতলকুচি, সীতাই, মাথাভাঙা – এসব অঞ্চলে। তখন বম্বে থেকে ডঃ সরোজ খাপাডে তাঁর মেডিক্যাল টিম নিয়ে হাজির হন। আমার কাছে এলে, আমরা ওঁদের থাকার বন্দোবস্তও করে দিই। ক্যাম্পে নিরন্তর হাইজিন স্যানিটেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। কোচবিহারের ডিসি অশোক বসু এবং এসপি শ্যামল দত্তও ছিলেন ওখানে।

পরিস্থিতি যখন এমন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একটি পরিকল্পনা করলেন। বাংলাদেশে যে নারকীয় সংহার চলছে, তা যদি রেডিও’র মাধ্যমে সম্প্রচারিত করা যায়। সে-সময় দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ইংলিশ ফিচারের ডিরেক্টর ছিলেন মেলভিল ডি মেলো। তিনি এলেন কোচবিহারে। আমাকে ওঁর সঙ্গে কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব দেওয়া হল, ইন্টারপ্রেটার হিসেবে। উনি অসাধারণ ফিচার করেছিলেন, যা ১৯৭১-এর সপ্তমী-অষ্টমী-নবমীতে সম্প্রচারিত হয়েছিল ইংরাজিতে। তাতে বলা হয়েছিল, কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে এগুলো নথিবদ্ধ করেছিলাম। মানুষ কীভাবে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, কীভাবে আমাদের এখানকার মানুষ তাঁদের ঠাঁই দিয়েছেন – সব। সেখানে আমারও খানিক বক্তব্য সম্প্রচারিত হয়েছিল। মিঃ ডি মেলো লাস্ট ইন্টারভিউটা আমারই নিয়েছিলেন, কোচবিহার সার্কিট হাউসে।

কিছুদিন পরের কথা। আমি তখন সীতাই অঞ্চলে। মনে আছে, সীতাই-এর একটা পোস্ট থেকে ৫০ জনের উদ্বাস্তু দল সীমানা অতিক্রম করে আসেন। একদিন বা দেড়দিন হেঁটে তাঁরা সীমান্তে পৌঁছেছিলেন। অভুক্ত সকলেই। আমাদের পোস্টে ১০-১২ জন বিএসএফ ছিল। তখন বিএসএফের সংখ্যাও কম ছিল। ২,২১২ কিলোমিটার বর্ডারের জন্য, আমাদের ৭-৮টা ব্যাটালিয়ান ছিল। আমাদের রেশনের সংস্থানও ছিল না প্রচুর। তবু আমাদের কাছেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেই রাতে। উদ্বাস্তুদের জন্য খিচুড়ি আর তরকারি রান্না হল, আর বাচ্চাদের জন্য দুধ জোগাড় করে নিয়ে আসা হল কাছেপিঠের গ্রাম থেকে। আমি বিডিও-কে খবর পাঠিয়ে, পরেরদিন রিফিউজি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলাম ওঁদের।’

আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প

বইয়ের পাতার ইতিহাস যেন জলজ্যান্ত হয়ে উঠছে ওঁর মুখে। চোখ বুজলেই যেন পৌঁছে যাওয়া যাবে সেদিনের পরিস্থিতিতে। ওপারে আগুন, চিৎকার। মৃত্যুমিছিল। তারই মধ্যে, প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসছেন মানুষ। সব হারিয়েছে যাঁর, প্রাণটুকু নিয়ে মায়া না করে উপায় কী! ভবিষ্যৎ কী হবে, অজানা। আপাতত রাজাকার আর খানসেনাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাক। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ আর কীই বা করতে পারে!

‘আস্তে আস্তে ক্ল্যান্ডেস্টাইন ওয়ারফেয়ার শুরু হল। বাংলাদেশের যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁরা আস্তে আস্তে জড়ো হতে আরম্ভ করলেন। আমাদের কাছে তাঁদের পাঠানো হল। শুধু আমার কাছেই নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গাতেই। এখানে, যেহেতু আমি বাঙালি অফিসার ছিলাম, আমার কাছে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তখন মে-জুন মাস। পরবর্তীকালের বাংলাদেশের ক্যাবিনেটের তিনজন মন্ত্রীও আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের এখানে। তাজউদ্দীন আহমেদকে কলকাতায় তাম্রভবনে রাখা হল। ইন্দিরা গান্ধীও একাধিকবার এসেছেন সেখানে। সেসময় পশ্চিমবঙ্গের আইজি ছিলেন গোলোক মজুমদার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এখনও তাঁর ভূমিকা ও অবদান অনেকটাই অচর্চিত। অন্যদিকে, কোনো ডিপ্লোম্যাটিক হাইকমিশনে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম ওঠে কিন্তু কলকাতাতেই, পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে।

আমি তখন শীতলকুচিতে। তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হল দিনহাটা অঞ্চলে, গিতালদায়। সেখান থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার আগে গিতালদা ডিওপি, যেখানে ধরলা নদী রয়েছে। সেই নদীতে ব্রিটিশ আমলের একটা ব্রিজ আছে। সেখানে গিয়ে নতুন করে আমাদের ডিপ্লয়মেন্ট করতে হল। কেননা ওপার থেকে পাক সেনারা প্রায়ই মর্টার কিংবা স্মল আর্টলারি ফায়ার করছিল। আমাদের কোনো বাঙ্কার ছিল না সেসময়। নর্মাল পুলিশিং করা বর্ডারে হঠাৎ এমন হবে, ভাবতে পারেনি কেউই। সরকারের রিসোর্সও তেমন ছিল না সে-আমলে। এদিকে দিনের মধ্যে চার-পাঁচবার করে ওরা শেলিং করছে আর আমরা জবাব দিচ্ছি।

রাত্রের অন্ধকারে ধরলা নদীর ব্রিজের পিলারের দু’পাশে দুটো এমএমজি আমি সেট করে দিলাম। পাক সেনারা ফায়ার করলেই আমরাও ফায়ার ব্যাক করতে পারব। আর, গীতালদা থেকে মোগলহাট হয়ে লালমনিরহাট যাওয়ার একটা বাতিল রেললাইন ছিল। গ্রামের লোকেদের ডেকে আমি সাহায্য চাইলাম। তাঁদের বললাম, ফক্স হোল বানাতে চাই এখানে। যাতে ডাইরেক্ট ফায়ারিং হলে আমাদের সেনারা না মরে। প্রায় গোটা কুড়ি ফক্স হোল বানানো হল, এবং আমাদের সেনাদের জন্য সুন্দর বাঙ্কারের মতো তৈরি হয়ে গেল।

আমি নিজেও একটা ছোট খড়ের চাল দেওয়া ঘরে থাকতাম, যেটা একই সঙ্গে অফিস কাম শোওয়ার জায়গা ছিল। একদিন খেতে বসেছি, খড়ের চাল ফুঁড়ে সেই গুলি এসে পড়ল আমার খাবারের প্লেটে। ওপার থেকে পাক সেনারা ফায়ার করেছিল ওটা।

আরও পড়ুন
সিঁড়িতে আজও শুকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ

গিতালদা থেকে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্লান্ডেস্টাইন অপারেশনে পাঠাতাম নৌকোয় করে। আর শীতলকুচি ছিল ল্যান্ড বর্ডার। শুরুতে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ ভয়ে-ভয়ে থাকত। বেশিরভাগই বয়সে কিশোর। এত বড় লড়াই। আমরা সাহস দিতাম। আমি নিজে সীমান্তে দাঁড়িয়ে থেকে, রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠাতাম। অপারেশন করে না-ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করব – এই আশ্বাসও দিতাম। ‘This is your country, you have to take part.’

আমরা যখন গীতালদায় এলাম, একবার প্রায় ৫০০ জন রাজাকার এসে সারেন্ডার করল। ওপেন এরিয়াতেই, ঘের দিয়ে ওদের রাখা হল।

৩ ডিসেম্বর, সরকারিভাবে যুদ্ধ ঘোষণা হল। আর আগে যেটা ক্লান্ডেস্টাইন ওয়ারফেয়ার চলছিল, সেটা আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে পরিণত হল। বাংলাদেশে প্রবেশের পথে আমাদের আর বাধা রইল না। তারপর…’

উৎকণ্ঠা বাড়ছে আমাদেরও। ওপারে গিয়ে, কী করলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডান্ট সমীর মৈত্র ও তাঁর বাহিনী? ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, বাংলাদেশে প্রবেশ করে কী দেখলেন তাঁরা? পাকিস্তানি সৈন্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল? অজস্র প্রশ্ন ভিড় করে আসছে মাথায়। সমীরবাবুর ‘তারপর…’ বলে থেমে যাওয়া আমাদের কৌতূহল বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও। এ-কৌতূহল ইতিহাসকে জানার। যে-সময়ের সাক্ষী ছিলাম না আমরা, তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা। বাহিনীর একজন হয়ে, মনে-মনে আমরাও কি ঢুকে পড়ব, বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে? বলুন, সমীর মৈত্র, একুশ শতকের এই যুবকদের সঙ্গে নেবেন না আপনি?

(ক্রমশ)