হাসপাতালের নাম হবে রাধাগোবিন্দ করের নামেই, লক্ষাধিক টাকার প্রস্তাব ফিরিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে নেতাজির ঘোড়ার মুখটা যেদিকে আছে, সেইদিকে সোজা চলে গেছে একটি রাস্তা। পাঁচমাথার একটি মাথা। রাস্তা দিয়ে গেলেই প্রথমে পড়বে পরেশনাথের মন্দির। আর তার পরেই কিছুটা গেলে পড়বে হাসপাতাল। গোটা পশ্চিমবঙ্গ একডাকে যাকে চেনে ‘আর জি কর সরকারি হাসপাতাল’ হিসেবে। সারাদিন রোগী ও তাঁর পরিজনদের ভিড় ছড়িয়ে আছে সেখানে। কারোর মুখে হাসি, কারোর আবার শঙ্কা। কেউ আবার সদ্য প্রিয়জন হারানোর কষ্টে মুষড়ে আছেন। সমস্ত অভিজ্ঞতাই ১৩২ বছর ধরে দেখে চলেছে এই হাসপাতাল। কিন্তু এর আড়ালেই লুকিয়ে গেছেন আরও একজন মানুষ। কলকাতায় চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চার প্রসারে যার ভূমিকা চিরস্মরণীয়। এই কাহিনি আর জি করের কাহিনি; ডাঃ রাধাগোবিন্দ করের কাহিনি।

১৮৫০ সালে হাওড়ার সাঁতরাগাছির বেতড়ের বিখ্যাত কর পরিবারে জন্ম নেন রাধাগোবিন্দ কর। পরিবারে এর আগেই জন্ম নিয়েছেন একেকজন করিৎকর্মা মানুষ। রাধাগোবিন্দের বাবা দুর্গাদাস কর নিজেই ছিলেন তাঁর সময়ের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক, অধ্যাপক এবং গ্রন্থকার। পিতামহ ভৈরবচন্দ্র কর ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের জাঁদরেল উকিল। কাজেই শিক্ষার পরিবেশ ছোট থেকেই ছিল বাড়িতে। তবে ডাক্তারের ছেলে যে ডাক্তারই হবে, এমন ব্যাপার প্রথমেই বোঝা যায়নি। কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর বাবার নির্দেশেই ডাক্তারি পড়া শুরু করেন রাধাগোবিন্দ। ততদিনে তাঁর রক্তে ঢুকে গেছে থিয়েটার। ছোটবেলাতেই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন পিতৃবন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের। তখন থেকেই কি নাটক-প্রীতি? জানা যায় না।

গিরিশ ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি প্রমুখদের সঙ্গে বাগবাজারে অ্যামেচার থিয়েটার করেন তিনি। অভিনয়ও করেন। কিন্তু এতসবের মধ্যে ডাক্তারি পড়াটা একেবারেই হচ্ছিল না। এরই মধ্যে রাধাগোবিন্দ’র জীবনে এমন দুটি ঘটনা ঘটল, যা তাঁর জীবনকে বদলে দিল সম্পূর্ণ।

১৮৭৯ সাল নাগাদ একবার সম্পূর্ণ বিনাদোষে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন রাধাগোবিন্দ কর। কয়েকদিন হাজতবাসও করতে হয় তাঁকে। সেই সময়ই নিঃসন্তান অবস্থায় তাঁর স্ত্রী মারা যান। এই দুটি ঘটনা তাঁকে আমূল বদলে দেয়। তাঁকে স্থিতধী করে তোলে, আরও মনোযোগী করে তোলে। এরপরই আবার নতুন করে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন তিনি। পরে বিদেশে গিয়ে বিশেষ ডিগ্রি লাভ করে ডাক্তারি পড়া সম্পূর্ণ করেন তিনি। দেশে ফিরে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত হন মানুষের কাজে।

ডাক্তার হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়াতে সময় লাগল না। নিজের গুণে রোগীদের কাছে আপন হয়ে উঠলেন তিনি। তবে দুটি ঘটনার উল্লেখ না করলে তাঁর জীবন সম্পূর্ণ হয় না। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় দেখা দিল প্লেগ। দিনে দিনে মহামারীর আকার নিয়ে নিল রোগটি। এই সময়ই রোগীদের সেবার কাজে একদম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর। নিজের খরচেই শুরু করতে থাকেন চিকিৎসা। শুধু তাই নয়, দরিদ্র রোগীদের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্বও নিয়েছিলেন তিনি। এই কাজের সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় ভগিনী নিবেদিতার।

তবে তাঁর প্রধানতম অবদান বোধহয় বাংলায় চিকিৎসাশিক্ষার বিস্তার ঘটানো। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল স্বদেশি ভাবধারা। বেঙ্গল কেমিক্যালের ওষুধ যাতে বাজারে সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই কাজে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। সেইসঙ্গে চলতে থাকে ডাক্তারি শিক্ষার কথা। বাংলা ভাষায় বহু বই লিখে গেছেন তিনি। বাবা দুর্গাদাস করের মতো ইনিও মাতৃভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসারের কাজকে গুরুত্ব দিতেন। সালটা ১৮৮৬। ডাঃ রাধাগোবিন্দ করের এই ভাবনার সঙ্গে হাত মেলালেন সেই সময় কলকাতা শহরের আরও নামজাদা ডাক্তারেরা। যাঁদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ নীলরতন সরকার, ডাঃ বিপিন বিহারী মৈত্র, ডাঃ অক্ষয়কুমার দত্তের মতো মানুষরা। ঠিক করা হয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক একটি মেডিক্যাল বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। যেখানে মাতৃভাষায় ডাক্তারি শিক্ষা দেওয়া হবে। তৈরি হল ‘ক্যালকাটা স্কুল অফ মেডিসিন’। ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর হলেন এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সম্পাদক। একবছর পর এর নাম বদলে রাখা হয় ‘ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল’।

এরপর প্রতিষ্ঠানের জায়গা বদল হয়েছে অনেকবার। কিন্তু নিয়ম বদলায়নি। বাংলাতেই চিকিৎসাবিদ্যার যাবতীয় জিনিস শেখানো হত এখানে। পাশাপাশি চলত রোগীদের দেখাশোনাও। ১৮৯৮ সালে হাসপাতাল ও স্কুল একসঙ্গে খোলার জন্য শ্যামবাজার আর বেলগাছিয়ার মাঝখানে একটি জমি কেনা হয়। সেখানেই তৈরি হয় নতুন ভবন। এরই মধ্যে ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর। তাতেই মারা যান তিনি।

এরপর গঙ্গা দিয়ে গড়িয়ে গেছে অনেক জল। দেশও তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। ১৯৪৮ সালে এক ধনী ব্যক্তি বেলগাছিয়ার এই হাসপাতালে লক্ষাধিক টাকা দান করতে চান। শর্ত একটাই, তাঁর পরিবারের কারোর নামে এই হাসপাতালের নাম করা হোক। টাকার অঙ্ক বড় হওয়ায়, রাজি হয়ে যায় অর্থ-সংকটে ভুগতে থাকা হাসপাতাল কমিটিও। কিন্তু এই সময় মাঠে নামেন আরও এক কিংবদন্তি চিকিৎসক। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে। শোনামাত্র নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব। আটকে দিয়েছিলেন ওই টাকা নেওয়ার কাজ। তারপরেই বেলগাছিয়ার সেই হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রাধাগোবিন্দ কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল; সংক্ষেপে ‘আর জি কর হাসপাতাল’। পরে সরকারি হাসপাতালেরও স্বীকৃতি পায় এটি।

আজ বহু মানুষের ভরসা এই হাসপাতাল। কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। কিন্তু সবার অলক্ষে বসে আছেন যে মানুষটি, তাঁর কথা অনেকেই ভুলে গেছেন। অথচ তিনি না থাকলে এর কিছুই হত না। মাতৃভাষায় ডাক্তারি শিক্ষার শুরুটাও বোধহয় অনেক দেরিতে হত। বিস্মৃত বাঙালি হয়েই হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মূর্তি হয়ে আছেন ডাঃ রাধাগোবিন্দ কর, নিজেরই নামের তলায়।

ঋণস্বীকার:-  কালি ও কলম, বাঙালি চিকিৎসাশাস্ত্র-চর্চার ঐতিহ্য
আনন্দবাজার পত্রিকা, বেতড়ের রেনেসাঁ পুরুষ রাধাগোবিন্দ কর

Powered by Froala Editor