মৃত্যুদণ্ড ও রাষ্ট্রকে নিশানা করেছিল সস্তায়-বানানো কিছু সিনেমা

‘আমি মনে করি যে, সিনেমা... তাকে অবশ্যই হতে হবে জুতোয় নিয়ে চলা কাঁকরের মতো।’

কথাটা বলেছিলেন ডেনমার্কের লার্স ভন ত্রায়ার। কেন এই দাবি সিনেমা-র ওপর? ব্যাখ্যা করেছেন নিজেই, দর্শকের কাছে শিল্প উপভোগের ব্যাপার নয়, বরং যা উত্যক্ত করে, বিব্রত করে, দ্বিধায় ফেলে দেয়। শিল্প এমন কিছু বলতে চায় যা অনুচ্চার্য, মনে করেন তিনি, ‘এবং আমাদের ভাষা থেকে সেই ‘শব্দ’টির অপসারণ ঘটানোর মানে একটাই – গণতন্ত্রের দেওয়াল থেকে একটি ক’রে ইঁট খসিয়ে দেওয়া’।  

অতি তরুণ বয়স থেকেই ত্রায়ার পরিচালনা শুরু করেন। কয়েকটি ফিচার বানিয়েই ১৯৯৫ সালে বন্ধু টমাসবার্গের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশ করেন ‘ডগমা ম্যানিফেস্টো’। ‘ছবি বানানো সম্পর্কে যে গুজবটা রটানো হয়, তা সত্যি নয়, কেননা ছবি বানানো আদৌ কঠিন নয়,’ তাঁদের মত। ডিজিটাল প্রযুক্তি বাজারে চলে আসায় সিনেমাকে ইন্ডাস্ট্রির কুক্ষিগত রাখা অসম্ভব, বুঝেছিলেন এই যুবকেরা। সিদ্ধান্তটি ছিল কালাপাহাড়ি এবং পুঁজিবাদী নন্দনতত্ত্ব গুঁড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।     

add

তখন হলিউড পরের-পর বানিয়ে যাচ্ছে বিগ-বাজেট ছবি, সে ‘জুরাসিক পার্ক’-ই হোক কিংবা ‘টাইটানিক’। সিনেমা যতটা না শিল্প, তার চেয়ে অনেক বেশি দল-বেঁধে থিয়েটারে আমোদ দেখার প্যাকেজ। ‘ডগমা ম্যানিফেস্টো’-র দাবি সেখানে একেবারেই উলটো।  নতুনদের উদ্দেশে তার পরামর্শ, যতটা পারো বাজেট কমাও। খারাপ ক্যামেরা, কোই পরোয়া নেই। স্ট্যান্ডের দরকার নেই, হাতেই ধরে রাখো, ছবি কাঁপছে কাঁপুক। বাইরে থেকে মিউজিক চাপিও না, আবহ রাখতে হলে লোকেশনেই বাজনাদারকে নিয়ে আসো। যা আছে হাতের কাছে, তাই দিয়ে ছবি করো; গুছিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে যেও না। স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের মতোই চাই স্বতঃস্ফূর্ত ছবি – যা হবে জ্যান্ত, খরখরে, যোগাযোগে-সক্ষম, ভাঁওতা-বর্জিত।    

১৯৯৮ সালে ত্রায়ার তোলেন ‘দা ইডিয়টস’, তাঁর নিজেরই লেখা ম্যানিফেস্টো মেনে ছবিটা শুট করা হয়। পাগলের ভান করে ছুটি কাটাতে আসা একদল নারী-পুরুষ, এরাই ছিল ‘ইডিয়টস’এর চরিত্র। শুদ্ধ অর্থে এটাই তাঁর একমাত্র ‘ডগমা ছবি’, কেননা ত্রায়ার নিজেই পরের ছবিগুলিতে ডগমার কিছু-না-কিছু শর্ত থেকে সরে এসেছেন। হয় তিনি ছবির জন্য বাইরে থেকে চাপিয়েছেন আবহ, নচেৎ পুরো একটা কৃত্রিম সেট বানিয়ে নিয়েছেন, যে-দুটো কাজই ম্যানিফেস্টো-র শর্ত লঙ্ঘন করছে। অন্যদিকে, টমাস ভিন্টেরবার্গ ঐ একই বছর (১৯৯৮ সাল) তৈরি করেন  ‘ফেস্টেন’, এটিও ছিল ম্যানিফেস্টোর শর্ত মেনে তোলা, অর্থাৎ আরেকটি ডগমা ছবি। বিত্তবান পিতার জন্মদিন উপলক্ষে পরিবারের সদস্যরা সবাই মিলেছে একটি বাড়িতে, তাদের উৎসবের কয়েক ঘণ্টার গল্প বলে ‘ফেস্টেন’।

add

মুহুর্মুহু জাম্প কাট, থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা ক্যামেরা, অতি সস্তা রেজোলিউশন, খরখরে সম্পাদনা,  সর্বোপরি কেচ্ছাময় আঁশটে গল্প - দুজনের ছবিই যথেষ্ট শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। ফেস্টিভালে  পুরষ্কার, তুমুল নিন্দে ও উচ্ছ্বাস। কেউ কেউ নাক কুঁচকেছেন, ‘এ তো অ্যামেচার পর্ণোগ্রাফি হয়ে গেছে!’ জনৈক সমালোচক ত্রায়ারের ‘ইডিয়টস’ দেখে চেঁচান, ‘অসুস্থ ছবি!’ এই ব’লে। দুই বন্ধুই কার্যত জিতে যান বাজি, কেননা সিনেমার সঙ্গে অবিকল মিলে গেছিল জুতোর ‘কাঁকর’-এর তুলনা।

২০০০ সালে ত্রায়ার তুললেন তাঁর মাস্টারপিস ‘ডান্সার ইন দা ডার্ক’, এখানেও বিদ্রোহ অব্যাহত থাকে। অ-বাস্তব সেট, উৎকট মেলোড্রামা, গা-ঘিনঘিনে দরদ – সব কিছু নিয়েই আধুনিক সভ্যতার এক নির্মম প্যারোডি।  গায়িকা বিয়র্ক ছবিতে অভিনয় করলেন এক স্নেহশীল মায়ের চরিত্রে। যখন তখন দিবাস্বপ্ন দেখার রোগ ছিল এই ছোটোখাটো শান্ত মহিলাটির। অনিচ্ছাকৃত একটি খুনের দায়ে ফেঁসে তাকে বন্দি হতে হয়। সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র খুবই যত্ন নিয়ে তার বিচার করে, এমনকি বেশি যন্ত্রণা না পেয়েই যাতে সে মারা যায়, সেই ব্যবস্থা করে দেয়। জানানো হয় ফাঁসির দিন ।

আসামির দিবাস্বপ্ন দেখা কিন্তু থামে না। মঞ্চে ওঠার সময় প্রহরী থেকে জহ্লাদ সকলেই মার্জিত ব্যবহার করে তার সঙ্গে। যেই কালো রঙের মুখোশটা তাকে পরিয়ে দেওয়া হবে, অমনি সে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়, কান্না জুড়ে দেয়। গলায় দড়ি পরানোই অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফাঁপরে পড়ে যায় সভ্য রাষ্ট্র। কী করা যায়?

add

দিবাস্বপ্নের অসুখকে ধন্যবাদ, কেননা আসামী আবার ঘোরের মধ্যে চলে এসেছে। তার মনে হয়, এই ফাঁসির মঞ্চ একটা কার্নিভাল যেন, এখানে সবাই হাতে হাত ধরে আনন্দ করছে, সুরেলা গান গাইছে। সুখে তার মন ভরে ওঠে, হুঁশ চলে যায়। নড়বড়ে ছোট্টো শরীরটাকে তক্তা দিয়ে বেঁধে সাফল্যের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। নিচে খসে পড়ে তার পুরু কাচের চশমা, যেটা পরলেও সে আর কিছুই দেখতে পেত না শেষের দিকে।

এক অন্ধ, নির্দোষ, সরল মানুষকে হত্যা ক’রে এভাবেই দরদী রাষ্ট্র ন্যায়ধর্ম পালন করে। আপাদমাথা অশালীন এই কমেডি বানিয়ে পরিচালক ত্রায়ার কি বলতে চান, আধুনিক সভ্যতা বেচে দিয়েছে নিজের বিবেক? গণতন্ত্র ও ভোগবাদের সুন্দর হাসির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে অনেক আর্তনাদ? অতি সহজে এখন ভুলিয়ে দেওয়া যায় শতাব্দীর ইতিহাস, গণমাধ্যমের তরফে ঢালাও আয়োজন থাকে চকচকে ফ্যান্টাসির। তোমার নিজের হত্যাও তোমার কাছে হয়ে উঠতে পারে সুখকর, যখন বিভ্রমের জগতই তোমার কাছে বাস্তব, জুতোর মধ্যে কাঁকরটিকে অনুভব করতেও যখন তুমি ভুলে গেছ!

‘রাজনৈতিক ভাবে ‘ঠিক’ হওয়া মানে যেকোনো আলোচনাকে শুরুতেই হত্যা করা, কেননা তাহলে আর উঠতে পারে না একটিও অনিরাপদ প্রসঙ্গ’, মনে করেন এই নির্মাতারা। ...ত্রায়ার-ভিন্টারবার্গদের ছবি অথবা পঁচানব্বই সালের ডগমা ম্যানিফেস্টো আর কিছুই না, বিশ্বায়িত মানবতা-র পিঠে একেকটি নির্দয় চাবুক – যা মারা হয়েছে আমাদেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত চেয়ে।