১৯৬৯ সাল। বিশ্বের প্রথম মানুষ হিসাবে চাঁদে পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। তৈরি হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস। যার নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা। তারপর পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও, আজ পর্যন্ত দ্বিতীয় কোনো দেশের নাগরিকই পৌঁছাতে পারেনি চাঁদে। তবে চাঁদে পা রাখার পর যদি পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন করাই দুষ্কর হয়ে উঠত আর্মস্ট্রং-এর? যদি চাঁদের বিপজ্জনক তেজস্ক্রিয় পরিবেশের শিকার হতেন তিনি?
ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা? চাঁদে আবার কীসের তেজস্ক্রিয়তা? হ্যাঁ, চাঁদের পরিবেশ স্বাভাবিকভাবে তেজস্ক্রিয় নয় ঠিকই। তবে চাঁদের বুকে বড়ো কোনো পারমাণবিক বিস্ফোরণ হলে, তা যে বছর পর বছর ধরে তেজস্ক্রিয় থাকত, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তেমনটা হল, মানুষ হয়তো আগামী একশো বছরেও পা ফেলত পারত না চাঁদের (Moon) মাটিতে। আর এমনই আশ্চর্য এক পরিকল্পনা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের একত্রিত করে পরমাণু বোমা (Nuclear Bomb) তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম তা ব্যবহৃত হয়েছিল জাপানের ওপর। সে-সময় বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসাবে পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার ছিল কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। পরবর্তীতে এই তালিকায় নাম লেখায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই সূত্র ধরেই টানাপোড়েন শুরু হয় এই দুই মহাশক্তির মধ্যে। শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ। ঠান্ডা লড়াই।
চল্লিশের দশকের শেষ থেকে দুই দেশ ক্রমশ বাড়িয়েছে নিজের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। যা এক মহাদেশ থেকে পাড়ি দিতে পারে অন্য মহাদেশে। এক্ষেত্রে কোথাও গিয়ে যেন যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যকেও ছাপিয়ে যায় সোভিয়েত। ১৯৫৭ সাল। আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে মহাকাশে সফলভাবে কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ স্থাপন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের গবেষকরা। অন্যদিকে একইরকম পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের থাকলেও, ব্যর্থ হয়েছিল সেই প্রচেষ্টা। মাঝ আকাশেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল মার্কিন রকেট ভ্যানগার্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম তো বটেই, এই ব্যর্থতায় আন্তর্জাতিক স্তরেও রীতিমতো মুখ পড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের।
এই ব্যর্থতা ঢাকতেই তাই চাঁদে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পরিকল্পনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য, চাঁদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি সম্পর্কে সোভিয়েতকে হুঁশিয়ার করা। যাতে শুধু সোভিয়েতের নেতৃত্বরাই নয়, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যেও তৈরি হয় ভয়ের বাতাবরণ।
এ১১৯। পরিকল্পনাটি এই বিশেষ সাংকেতিক নামেই পরিচিত ছিল পেন্টাগনে। আর তা বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মার্কিন গবেষক এবং বিমান বাহিনীকে। ১৯৫৮ সালে পেন্টাগনের থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পর এই বিশেষ মিশনের কাজ শুরু করেন কিংবদন্তি পরমাণু বিজ্ঞানী লেওনার্ড রেইফেল। যিনি এনরিকো ফার্মির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৈরি করেছিলেন পারমাণবিক চুল্লি। পাশাপাশি এই প্রকল্পটির সঙ্গে জুড়ে ছিলেন আরেক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী কার্ল সেগানও।
১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন ও গবেষণাপত্র রচনা করেন রেইফেল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল একাধিক সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা। রেইফেল জানিয়েছিলেন, চাঁদের পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটালে তৈরি হবে না কোনো মাশরুম ক্লাউড বা ছত্রাকাকার মেঘ। তবে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা মতো হিরোশিমায় বিস্ফোরিত বোমার থেকে কয়েকগুণ শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ হলে, তা খালি চোখে দেখা সম্ভব পৃথিবী থেকে। আর তেমনটা করতে হলে, চাঁদের টার্মিনেটর লাইন অর্থাৎ আলোকিত ও অন্ধকার অংশের সীমানায় এই বোমা ফাটালে, তা সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।
অবশ্য শেষ পর্যন্ত রেইফেলের এই গবেষণাপত্রের জন্যই পরিকল্পনা বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও মার্কিন রিপোর্টে স্পষ্টভাবে কোনো কারণ উল্লেখিত নেই পরিকল্পনা বাতিলের। তা সত্ত্বেও একদল গবেষকের ধারণা, বিস্ফোরণের ফলে তৈরি মাশরুম ক্লাউড স্থায়ী হতে পারে দীর্ঘদিন। তবে আলোর চমক দেখা যায় কেবলমাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। ফলে, ব্যাপারটা সার্বিকভাবে সমস্ত সোভিয়েতের মানুষের নজরে আসা সম্ভব নয়। আর সেই কারণেই শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়ে গিয়েছিল মিলিয়ন ডলারের এই প্রোজেক্ট।
১৯৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সর্বপ্রথম এই গোপন পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেছিলেন কার্ল সেগান। অবশ্য এই প্রকল্পের সময় তাঁর বয়স নিতান্তই কম। সে-সময় অনেকেই বিশ্বাস করেননি কার্ল সেগানের কথা। উঠেছিল সমালোচনার ঝড়ও। তবে ২০২০ সালে প্রকাশ্যে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গোপন নথি। যা নিশ্চিত করে, আক্ষরিক অর্থেই চাঁদে পরমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র। অবশ্য সম্পূর্ণ নথি পাওয়া যায়নি। গোপনীয়তা বজায় রাখতে এই নথির অধিকাংশটাই নষ্ট করে ফেলেছিল খোদ পেন্টাগন। বলার অপেক্ষা থাকে না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রকল্প যদি বাস্তবায়িত হত, তবে চাঁদের পরিবেশ মোটেও নিরাপদ হত না মানুষের পক্ষে। পাশাপাশি চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ বল কম হওয়ায়, গোটা চাঁদেই ছড়িয়ে পড়ত পারমাণবিক দূষণ, পারমাণবিক বর্জ্য, তেজস্ক্রিয়তা। আর তেমনটা হলে চাঁদে পা রাখা তো দূরের কথা, দুরূহ হয়ে উঠত চন্দ্রগবেষণার কাজও…
Powered by Froala Editor