ক্যামেরার জন্য বিশেষ ইন্ডিকেটর বানালেন উপেন্দ্রকিশোর, বদলে গেল ছবি তোলার দৃষ্টিভঙ্গিও

যে প্রসেস ক্যামেরার কথা আগেই বলেছি, সেটা আর একটু বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন। সাধারণ ক্যামেরার সঙ্গে প্রসেস ক্যামেরার মূল পার্থক্য একটি কাচের স্ক্রিন-ঘটিত। সূক্ষ্ম জাফরি কাটা এই স্ক্রিনের দৌলতেই মূল চিত্রটি নেগেটিভে বিন্দুর সমাহারে পরিণত হয়। আলোক-সংবেদী প্লেট বা ফিল্মের থেকে ঠিক কতটা দূরে এই স্ক্রিন স্থাপন করতে হবে, সেই হিসেবটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু সেকালের ব্লক-নির্মাতারা কিছুটা অন্ধের মতোই অভিজ্ঞতা-সর্বস্ব আচরণের পক্ষপাতী ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর পেনরোজের জন্য বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেন এই ‘রুল অফ দা থাম্ব’ বা হাতড়ে বেড়ানো পদ্ধতির অবসান ঘটানোর ইচ্ছায়- ‘দা হাফটোন ডট’ (১৮৯৮), ‘দা হাফটোন থিয়োরি গ্রাফিক্যালি এক্সপ্লেন্ড’ (১৮৯৯) ও ‘মোর অ্যাবাউট হাফটোন থিয়োরি’ (১৯০৩-০৪)। ব্যবহারিক কর্মের মধ্য দিয়েই অনেক কিছু আবিষ্কৃত ও উদ্ভাবিত হয় সত্য, কিন্তু তারপর এমন একটা সময় আসে যখন প্রয়োগকর্মের অন্তর্নিহিত তত্ত্বটিকে অনুধাবন করতে না পারলে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয় না। যান্ত্রিক উপায়ে স্ক্রিনদূরত্ব নির্ধারণের জন্য তিনি একটি যন্ত্রও উদ্ভাবন করেন। নাম ‘স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর’। তাঁর হয়ে পেনরোজ কোম্পানি এটির পেটেন্ট নেয় এবং নিজেদের প্রসেস ক্যামেরার অতিরিক্ত যন্ত্রাংশ (অ্যাটাচমেন্ট) হিসেবে তারা এটি বিক্রি করত।

১৯০১-এ পেনরোজ-এ উপেন্দ্রকিশোরের প্রবন্ধটিতে এই যন্ত্রের কার্যকরতার প্রমাণ দাখিল করতে উপেন্দ্রকিশোরকৃত ব্লকের চারটি নমুনা ছাপানো হয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোর জানিয়েছিলেন, এগুলি একবার মাত্র এচ্‌ করা ব্লক থেকে ছাপা। অর্থাৎ ফাইন-এচিঙ্গের কেরামতি এখানে একেবারেই অনুপস্থিত। ইলফোর্ড প্রসেস প্লেটে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোর লিখেছিলেন, প্রবন্ধটি রচনাকালে তাঁর প্রতিষ্ঠানে আগের মতো মাইক্রোস্কোপ ব্যবহারের পাট উঠে গেছে, তার আর প্রয়োজনও পড়ে না ‘স্ক্রিন ইন্ডিকেটর’ এর দৌলতে। খুব ছোটো ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আলো তার সরলরেখা চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়, অর্থাৎ কিঞ্চিৎ বেঁকে যায়। এই ঘটনাটিই ডি-ফ্র্যাকশান নামে পরিচিত।

উপেন্দ্রকিশোরের আগে হাফটোন ছবির তত্ত্ব নিয়ে যত আলোচনা সবই ছিল পিনহোল সংক্রান্ত (অর্থাৎ আলোর সরলরৈখিক বিস্তার সংক্রান্ত)। অথচ সকলেই জানতেন হাফটোন নেগেটিভের উপর ডি-ফ্র্যাকশানজনিত প্রভাব পড়েই। কিন্তু এ বিষয়ে স্বল্পজ্ঞানের জন্য বড়ো আকারের ছিদ্রযুক্ত ডায়াফ্রাম ব্যবহার করে ডি-ফ্র্যাকশান ঘটিত অনাচারের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই সকলে ব্যস্ত ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চাননি। ‘দা থিওরি অফ হাফটোন ডট্‌’-এ (১৮৯৮) তিনি লিখেছেন, ডিফ্র্যাকশানের দরুন একের পরে এক সাদা, কালো, সাদাকালো কিছু ‘ব্যান্ড’ সৃষ্টি হয় যার সাহায্যে নেগেটিভের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ডট্‌গুলিকে আরও পাকাপোক্ত করা সম্ভব। একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, “ডিফ্র্যাকশানের সাহায্য নিয়ে ইচ্ছামতো ভালো নেগেটিভ তৈরি করা খুবই শক্ত, কারণ ব্যান্ডগুলির উপর সর্বদা কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং সেগুলি ভুল স্থানে গঠিত হলে এমন নকশা সৃষ্টি হয় যা হাফটোন নেগেটিভের চেয়ে কার্পেটেই বেশি মানায়।” এ-সম্বন্ধে তাঁর বিস্তারিত আলোচনা ‘ডিফ্র্যাক্‌শান ইন হাফটোন’ প্রকাশিত হল ১৯০২-০৩ এর ‘পেনরোজ’-এ।

উপেন্দ্রকিশোর শুধু ব্যাখ্যা পেশ করেই নিরস্ত হননি, ডিফ্র্যাক্‌শানকে কাজে লাগানোর জন্য তৈরি করলেন একাধিক ক্ষুদ্র ছিদ্র বিশিষ্ট ডায়াফ্রাম, নাম দিলেন, ‘ডিফ্র্যাক্‌শান মাল্টিপ্‌ল স্টপ’। ডিফ্র্যাক্‌শান স্টপ ব্যবহার করার প্রধান সুবিধে হচ্ছে ভালো গ্রেডেশান লাভ ও মূল চিত্রের ছায়াময় অংশের প্রতিচ্ছবি গ্রহণে সাফল্য। তাছাড়া ডিফ্র্যাক্‌শানকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ হাফটোন ডট্‌কে ভেঙে ক্ষুদ্রতর ডটে পরিণত করা সম্ভব যা আর অন্য কোনো উপায়েই সম্ভব নয়। এই ডিফ্র্যাক্‌শান স্টপ ব্যবহার করেই উপেন্দ্রকিশোর ইঞ্চি-পিছু স্ক্রিনের লাইন-সংখ্যার দ্বিগুণ বা চতুর্গুণ ডট পেতেন হাফটোন ছবিতে। ‘হাউ মেনি ডটস’ নামে একপাতার একটি রচনায় (‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’ ১৯০১) তিনি তৎকালীন একটি ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করে জানিয়েছিলেন, ডাব্‌ল অ্যাপারচার ব্যবহার করলেই ছবিতে স্ক্রিন লাইন সংখ্যার দ্বিগুণ সংখ্যক ডট্‌ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় স্ক্রিনের লাইন সংখ্যার ১ ১/২ বা মোটামুটি ভাবে ১১/৭ গুণ ডট। অর্থাৎ ১১০ লাইন স্ক্রিনের ক্ষেত্রে ১৭০টি ডট। কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর ডিফ্র্যাক্‌শান স্টপের সাহায্যে ১১০ লাইন স্ক্রিন দিয়ে ২২০টি ডট-বিশিষ্ট ছবির ব্লক ছেপেছিলেন আলোচ্য রচনার সঙ্গে (‘দা উইচ অফ ঘুম’)। ফোর-লাইন স্ক্রিন মূলত ডিফ্র্যাক্‌শানের কাজের উপযোগী স্ক্রিন।

ডিফ্র্যাক্‌শান-বিষয়ক প্রবন্ধটির স্বভাবসিদ্ধ পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে উপেন্দ্রকিশোর বলেছিলেন, সঠিক ব্যবহার না জানলে হাজারো সম্পদ থাকলেও আমাদের অবস্থা দাঁড়ায় সেই প্রহরীর মতো, ‘যার এক হাতে আছে তরোয়াল অন্য হাতে ঢাল, তাই চোরটা যখন ছুটে পালাল প্রহরী তাকে পাকড়ে ধরতে পারল না।’ সাধারণ গ্লাস স্ক্রিনে দুইগুচ্ছ সমান্তরাল রেখা থাকে। প্রতিটিগুচ্ছের সমদূরবর্তী রেখাগুলি অপর গুচ্ছের সমান্তরাল রেখাগুলিকে ৯০ ডিগ্রিতে ছেদ করে। উপেন্দ্রকিশোর নতুন একটি স্ক্রিনের প্রস্তাব করেন যাতে ৯০ ডিগ্রির পরিবর্তে গুচ্ছদুটি ৬০ ডিগ্রিতে পরস্পরকে ছেদ করবে। এরকম একটি স্ক্রিন তৈরি হওয়ার আগেই ৬০ ডিগ্রি কোণে আনত রেখা বরাবর হাফটোন ডটের সজ্জার উপযোগিতার কথা তিনি ‘পেনরোজ অ্যনুয়াল’-এর ১৮৯৭ ও ১৮৯৮-এ তার প্রকাশিত রচনায় উল্লেখ করেন। তারপর দুই গুচ্ছের বদলে তিন গুচ্ছ রেখা, যাতে প্রত্যেকটি গুচ্ছের সমান্তরাল রেখাগুলি অপরটির সঙ্গে ৬০ ডিগ্রি কোণে আনত অবস্থায় থাকবে—এই ধরনের একটি স্ক্রিনের পরিকল্পনা করেন উপেন্দ্রকিশোর। স্ক্রিনটির নামকরণ করেন ‘থ্রি লাইন স্ক্রিন’।

১৯০৫-০৬এর ‘পেনরোজ অ্যানুয়াল’-এ দ্য সিক্সটি ডিগ্রি ক্রস-লাইন স্ক্রিন’ প্রবন্ধে থ্রি লাইন স্ক্রিন সম্বন্ধে উপেন্দ্রকিশোর লিখেছেন: “১৮৯৯ নাগাদ মেসার্স পেনরোজ কম্পানি মারফত আমি মিস্টার লেভিকে অনুরোধ করেছিলাম আমাকে এইরকম একটি স্ক্রিন তৈরি করে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। সত্যিই এ-ধরনের স্ক্রিন তৈরি করা খুব শক্ত। মিস্টার শুল্‌ৎজেও সেই কথা বলেছেন, এবং অন্যান্য নির্মাতাদের কাছে অনুরোধ জানানোর পর আমিও তা জানতে পেরেছি। কিন্তু এইসব অসুবিধার চরিত্র ও মাত্রা যা-ই হোক না, ফোর-লাইন স্ক্রিন নির্মাতার প্রতিভার কাছে [মিস্টার লেভি] তা কখনোই অনতিক্রম্য হতে পারে না। “যাই হোক, আমার পছন্দ মতো স্ক্রিন যখন নির্মাতারা তৈরি করলেন না, তখন তারা যা তৈরি করতে পারবেন তাই গ্রহণ করা ছাড়া আমার আর বিকল্প রইল না। আমি মিস্টার লেভিকে দিয়ে আমার জন্য একটা ৬০ ডিগ্রি ক্রস-লাইন স্ক্রিন তৈরি করিয়ে নিলাম। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই খবর পেলাম মিস্টার শুল্‌ৎজে এটির পেটেন্ট নিয়েছেন।” আশ্চর্য লাগে, যখন দেখি শুল্‌ৎজের লেখা থ্রি লাইন্‌ড হাফটোন এনগ্রেভিং’ প্রকাশিত হচ্ছে ‘পেনরোজ’ পত্রিকায় ১৯০৩-১৯০৪-এ, আবার পরবর্তী বছরে (১৯০৫-১৯০৬) একই পত্রিকায় উপেন্দ্রকিশোর রচিত এই পেটেন্ট গ্রহণের নেপথ্যকাহিনিও ছাপা হয়েছে কিন্তু অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো তিক্ততা প্রকাশ পায়নি। তিনি শুধু নৈর্ব্যক্তিকভাবে পুরো ঘটনাটির ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

তবে এই প্রসঙ্গে তাঁর সবচেয়ে স্মরণীয় উক্তি : To the craft it matters little who gets the credit for a particular invention. What directly concerns them is the addition of a valuable resource to their equipment. এর পরেই তিনি ৬০ ডিগ্রি স্ক্রিন সম্বন্ধে প্রবঞ্চক শুল্‌ৎজের প্রকাশিত রচনার কয়েকটি ত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছেন। ৬০ ডিগ্রি স্ক্রিনের উদ্ভাবক হিসেবে, পেটেন্ট তালিকার কোটি কোটি নামের মধ্যেই শুধু বেঁচে থাকবেন শুল্‌ৎজে। ৬০ ডিগ্রি স্ক্রিনের পেটেন্ট-কার হিসেবে অর্থ ছাড়া তিনি কিছুই পাননি, কেননা ৬০ ডিগ্রি স্ক্রিনের ব্যবহারবিধি সম্বন্ধে কিছুই তিনি জানতেন না। এই স্ক্রিনকে কাজে লাগাতে হলে, এর থেকে বিশেষ উপযোগিতা পাওয়ার জন্য কি আকৃতি ও আকারের স্টপ বা ডায়াফ্রাম ব্যবহার করতে হয় সেটাও হিসেব কষে, এঁকে, ব্যাখ্যা করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর, আলোচ্য প্রবন্ধটিতে।

(ক্রমশ)

উৎস-
১। প্রসঙ্গ উপেন্দ্রকিশোর-লীলা মজুমদার
২। কারিগরি কল্পনা ও বাঙালী উদ্যোগ- সিদ্ধার্থ ঘোষ
৩। ছবি ছাপার কল-কৌশল ও উপেন্দ্রকিশোর- সিদ্ধার্থ ঘোষ
৪। Essays on Half Tone Photography- Upendrakisore Roy Chowdhury (Jadavpur University)