প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের সন্ধানে থিয়েটার দলে লোক পাঠিয়েছিলেন সত্যজিৎ

১৯৭৪ সাল। ডিসেম্বর মাসের সন্ধে। আকাশকুসুম স্বপ্ন নিয়ে বিশপ লেফ্রয় রোডে হাজির হয়েছেন এক তরুণ। অবশ্য দোটানা চলছে তাঁর মনের ভেতর। এই শীতের দিনেও যেন ঘেমে উঠছেন তিনি একটু একটু। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। নেই ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ-ও। আগন্তুকের মতো এভাবে কিংবদন্তির বাড়িতে হাজির হওয়া কি আদৌ সমীচীন? এসব ভাবতে ভাবতেই কলিং বেলে আঙুলের চাপ দিলেন তিনি। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন দীর্ঘদেহী এক ব্যক্তি। আর তার পরের ঘটনাটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। বেশ আহ্লাদের সুরেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আরে এতদিন কোথায় ছিলেন তুমি? তোমাকেই তো খুঁজছিলাম!’

স্বল্পবয়সী যে তরুণের কথা হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন অভিনেতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায় (Pradip Mukhopadhyay)। সম্প্রতি ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে নাগেরবাজার এলাকার দমদম ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন প্রবীণ অভিনেতা। তবে ক্রমাবনতি হতে থাকে তাঁর শারীরিক অবস্থার। গতকাল তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল ভেন্টিলেশনে। তবে ব্যর্থ হল চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা। সোমবার সকালেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন ‘জন অরণ্য’-এর সোমনাথ। 

স্বপ্নের পিছনে যেমন ছুটে বেড়ায় মানুষ, কখনও কখনও স্বপ্নও তেমন বাস্তবের রূপ ধরে ধাওয়া করে বেড়ায় মানুষের পিছনে। অভিনেতা প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের গল্পটা যেন তেমনই। জন্ম, সিমলার চোরবাগানে। তারও বহু পরে কলকাতায় আসা। নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবার। আর্থিক অনটনের সঙ্গে লড়াই চলত রীতিমতো। তাই ছাত্রাবস্থা থেকেই শুরু হয়েছিল কাজের সন্ধান। 

তখন তিনি সিটি কলেজের ছাত্র, নাম লেখালেন নাটকের দলে। সন্ধেগুলো তপন থিয়াটারে অভিনয় করেই কেটে যেত তাঁর। হাতে যে দু-এক পয়সা জুটত তাতে হাতখরচ চলে গেলেও সংসার চলে কি? তাই, কলেজের গণ্ডি পেরনোর পরেই চাকরিতে যোগ দিতে হল। সেইসঙ্গে শুরু হল আইনের পড়াশোনা। তবে রোববারগুলো বরাদ্দ ছিল অভিনয়ের জন্যই। শ্যামল ঘোষের ‘নক্ষত্র’ থিয়েটারে যোগ দিলেন তিনি। ‘লম্বকর্ণ পালা’ নাটকে সুযোগও পেলেন নিজেকে মেলে ধরার। আলাপ হল টলিপাড়ার নানান রথি-মহারথির সঙ্গে। ততদিনে মাথাচাড়া দিয়েছে বেয়ারা এক স্বপ্ন। সিলভার স্ক্রিনে অভিনয়ের স্বপ্ন। ‘নক্ষত্র’-এর এক তরুণ অভিনেতা ততদিনে সুযোগ পেয়েছেন মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’-এ। অর্থাৎ, তরুণরা জন্য টলিপাড়ায় অভিনয়ের সুযোগ নেই, এমনটা নয়। তাঁর থেকেই জোগাড় করা গেল সত্যজিৎ রায়ের বাড়ির ঠিকানা। তারপর এক ভরা শীতের সন্ধেয় হাজির হওয়া সত্যজিতের বাড়িতে। 

আরও পড়ুন
ইতি সত্যজিৎদা—

পরের ঘটনাটা খানিক বলা হয়েছে শুরুতেই। উচ্ছ্বসিত হয়েই সত্যজিৎ জানান, তিনিও এতদিন সন্ধান করছিলেন তাঁরই। রবীন্দ্রসদনে ‘লম্বকর্ণ পালা’ দেখে নাকি তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর অভিনয়ে। এমনকি ‘নক্ষত্র’-এ লোক পাঠিয়েছিলেন এই তরুণ তারকাকে খুঁজে বার করার জন্য। কিন্তু নাম না জানায়, ব্যর্থ হয়েছিল সেই প্রচেষ্টা। এ যেন বিনা মেঘে বৃষ্টি। কিন্তু কেন খুঁজছিলেন তিনি? 

আরও পড়ুন
চিঠি লেখেন সত্যজিৎ

সেই রহস্যের যবনিকাপতন হয় আরও বেশ কিছুদিন পরে। ততদিনে সত্যজিতের সঙ্গে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে প্রদীপের। নিছক আড্ডা দেওয়ার জন্যই তাঁকে ডাক পাঠাতেন সত্যজিৎ। অফিস ফেরত তিনিও হাজির হতেন বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে। এমনই এক আড্ডার দিনে, খানিক অবাক করে দিয়েই তাঁকে নিজের নবনির্মিত চিত্রনাট্য পড়ে শোনান সত্যজিৎ রায়। সে-গল্পের মূল চরিত্র ‘সোমনাথ’ ও ‘জুথিকা’ নামের এক তরুণ-তরুণী। 

আরও পড়ুন
টুনটুনি আর হেঁশোরাম-এর অনুবাদে সত্যজিৎ

গল্পটা শুনে মুগ্ধ হওয়ার থেকেও বেশি বিস্মিত হয়েছিলেন প্রদীপ মুখোপাধ্যায়। ‘সোমনাথ’-এর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রের মিল প্রতিটা ক্ষেত্রেই। রোগা হওয়ার জন্য জামা না গুঁজে পরা, সিগারেট ধরা— সবটাই যেন তাঁরই মতো। দিন দুয়েক পরে রহস্যোন্মোচন করেছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ। জানিয়েছিলেন, এই চরিত্রে অভিনয় করতে হবে তাঁকে। প্রদীপ বুঝেছিলেন, আদতে আড্ডার অছিলায় তরুণ অভিনেতাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করাই ছিল তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য। অভিনেতার স্বাভাবিক আচার-আচরণকেই চরিত্রনির্মাণের কাজে ব্যবহার করে চেয়েছিলেন তিনি। শুধু বদলে গিয়েছিল তাঁর চুল আঁচড়ানোর ধরনটা। 

আরও পড়ুন
‘অপরাজিত’ সত্যজিৎ ও বাংলা চলচ্চিত্রের পদাবলী

১৯৭৬ সালে মুক্ত পায় কলকাতা ত্রয়ী সিরিজের শেষ ছবি ‘জন অরণ্য’। বলাই বাহুল্য, আজও বাংলা সিনেমার জগতে এই চলচ্চিত্র একটি মাইলফলক। প্রায় সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসে সোমনাথ চরিত্রটি এখনও তাজা বাঙালি দর্শকদের মনে। এই চরিত্রই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল খ্যাতির স্বর্ণশিখরে। দাঁড়াবার জায়গা করে দিয়েছিল টলিপাড়ায়।

না, আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। এর পর একে একে ‘গোলাপ বউ’, ‘দৌড়’, ‘দূরের নদী’, হিরের আংটি’, ‘শাখা-প্রশাখা’, ‘আনন্দনিকেতন’, ‘পুরুষোত্তম’-এর মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘যেখানে ভূতের ভয়’, ‘সজারুর কাঁটা’, ‘গয়নার বাক্স’-এর মতো সিনেমাতেও দেখা গেছে তাঁকে। না, টলিপাড়ার মহারথী হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর, কিন্তু তাঁকে ছাড়া অসম্পূর্ণই থেকে যায় বাংলা ছবি, অভিনয়ের ইতিহাস। এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ চলচ্চিত্রমহল…

তথ্যসূত্রঃ
১. সাক্ষাৎকার: প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, ডাকবাংলা.কম
২. আমি তো তোমাকেই খুঁজেছিলাম, প্রদীপ মুখোপাধ্যায়, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার 

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More