চার-চারবার বজ্রপাত শরীরে, রেহাই পাননি মৃত্যুর পরেও!

১৯৩৬ সালের এক সন্ধ্যাবেলা। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে সেদিন আকাশ এক ভয়ঙ্কর খেলায় মেতেছে। প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই আকাশ চিরে নামল বিদ্যুতের ফলা। না, কোনো জীবন্ত প্রাণীর ক্ষতি করেনি। বরং সমাধিপ্রস্তর ভেদ করে তা আঘাত করল একটি মৃতদেহকে। সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে ছাই হল দেহটি। তবে তার আগে কি মৃতদেহের মুখেও একটু হাসি ফোটেনি? একের পর এক বজ্রপাত যে তাঁর জীবনের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পরেও সেই বজ্রপাতের হাত থেকে মুক্তি নেই। ব্রিটিশ সেনা অফিসার ওয়াল্টার সামারফোর্ডের জীবন সত্যিই এক বিস্ময়।

পরিসংখ্যান বলে ১৩ হাজার বার বজ্রপাত ঘটলে তার মধ্যে একটি কোনো জীবিত প্রাণীর শরীরে আছড়ে পড়ে। আর একজন মানুষের জীবনে বিদ্যুৎপৃষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তো, ফেলুদার কথায়, ওয়ান্স ইন আ মিলিয়ন। আসলে প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু যদি এমন কোনো মানুষের কথা বলা হয়, একবার নয়, চারবার বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়েছেন যিনি! হ্যাঁ, প্রায় অবিশ্বাস্য এমন উদাহরণই তৈরি করে গিয়েছিলেন ওয়াল্টার সামারফোর্ড। জীবনের শুরুটা অবশ্য আর পাঁচজন মানুষের মতোই ছিল। আলাদা কিছু যে তাঁর সঙ্গে ঘটতে পারে, এমনটা ভাবতেই পারেননি অনেকে। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সেনা হিসাবে যোগ দিলেন ওয়াল্টার। আর কে না জানেন, সৈনিকের জীবন সবসময় অনিশ্চয়তার ভরা। কিন্তু সেইসব রোমাঞ্চ ওয়াল্টারের কাহিনির কাছে তুচ্ছ।

যুদ্ধে গোলা-বারুদ বা বন্দুকের গুলি নয়, ওয়াল্টারকে আঘাত করল আকাশ থেকে ছুটে আসা অস্ত্র। বজ্রপাত। সময়টা ১৯১৮ সাল। বেলজিয়াম শহরের বুকে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছিলেন ওয়াল্টার। হঠাতই শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। ঘোড়াটি সেখানেই প্রাণ হারাল। আর ওয়াল্টার প্রাণে বেঁচে গেলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর কোমরের নিচের অংশ পক্ষাঘাতে অকেজো হয়ে গেল। এরপর আর ইউরোপে থাকেননি ওয়াল্টার। চলে এলেন কানাডায়। কিন্তু বজ্রপাতের অভিশাপ সঙ্গে সঙ্গে এল আটল্যান্টিক মহাসাগরের এপারেও।

পক্ষাঘাতের পরেও নানা ছোটখাটো খেলাধুলোয় নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন ওয়াল্টার। আর মাঝে মাঝেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে নিয়ে চলে যেতেন মাছ ধরতে। ক্রমশ সেরেও উঠছিলেন একটু একটু করে। ঠিক এরকম সময়েই, ১৯২৪ সালে রাতের বেলায় মাছ ধরতে গিয়ে আবারও দুর্ঘটনার কবলে পড়লেন তিনি। বাকি বন্ধুদের কারোর কিছু হল না। শুধু তিনি যে গাছের নিচে বসেছিলেন, সেটিই বজ্রপাতে ঝলসে গেল। আর বিদ্যুতের প্রবাহ খেলে গেল তাঁর শরীরেও। এবারেও প্রাণ হারালেন না তিনি। কিন্তু শরীরের সম্পূর্ণ ডানদিক অকেজো হয়ে গেল।

আরও পড়ুন
ভেজা কাপড় থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় পুরস্কার বাঙালি গবেষকের

অবশ্য শেষ পর্যন্ত চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছিল তাঁর শরীর। কয়েক বছর পর হেঁটেচলেও বেড়াতে পারতেন দিব্যি। আর এই সময়েই সপ্তাহে একদিন অন্তত কোনো পার্কে ঘুরতে না গেলে তাঁর মন ভরত না। দিব্যি চলছিল সবকিছু। কিন্তু সেই অভিশাপ যে তখনও তাঁর পিছনে হানা দিয়ে ফিরছে। ১৯৩০ সাল, একটি পার্কের বনভূমিতে ঘুরতে ঘুরতেই আবারও বিদ্যুৎপৃষ্ট হলেন ওয়াল্টার। এবার কিন্তু একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। আর দুবছরের মাথায়, ১৯৩২ সালে মৃত্যু হল তাঁর। কিন্তু গল্পের শেষ হল না এখানেই।

আরও পড়ুন
থাইল্যান্ডে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু ক্ষুধার্ত হাতির, আঙুল উঠল মানুষের দিকেই

জীবদ্দশায় তিনবার বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়েছেন ওয়াল্টার। কিন্তু তাঁর শরীরের উপরে বজ্রপাত ঘটেছে ৪ বার। মৃত্যুর ৪ বছর পর ভ্যাঙ্কুভার শহরের সমাধিক্ষেত্রে সেই বজ্রপাতে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ওয়াল্টার সামারফোর্ডের শরীর। নাহলে হয়তো তার পরেও বারবার বজ্রপাতের আঘাত সহ্য করে যেতে হত তাঁকে। প্রকৃতি কি সত্যিই খামখেয়ালি? ওয়াল্টারের প্রতি তাঁর তীব্র আক্রোশ দেখে অন্তত তেমনটা মনে হয় না।

আরও পড়ুন
১৮৯৭ সালে যাত্রা শুরু সিইএসসি-র, জনপ্রিয়তায় গ্যাসবাতির কাছে হেরে গিয়েছিল বিদ্যুৎ

Powered by Froala Editor

More From Author See More