যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বসবাসের ঠিকানা, ফিরল বাঙালির হাতেই

‘ভাই জ্যোতিদাদা, আমরা আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি। সে কারণে তোমার চিঠি আসতে দেরি হয়েছে।... আমরা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি। বৌমা সেই বাড়ির কর্ত্রী। তাকে নিজেই রান্না করতে হচ্ছে।’ লিখছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিঠির উপরে ঠিকানা লেখা – ৫০ হাই স্ট্রিট, আর্বানা, ইলিনয়, ইউএসএ। সময়টা ১৯১২ সাল। প্রথমবারের মতো আমেরিকায় পা রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইতিমধ্যে লন্ডনের প্রকাশকের হাতে তুলে দিয়ে এসেছেন গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি। তবে আমেরিকায় এসে নিউ ইয়র্ক বা অন্য কোনো বড়ো শহরে উঠলেন না রবীন্দ্রনাথ। বরং ছোট্ট কৃষিনির্ভর গ্রাম্য এলাকা আর্বানাতে ভাড়া নিলেন একটি বাড়ি। একটানা ৬ মাস থেকেছেন সেখানে। পরে ১৯১৬ সালে আবারও সেই বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত সেই বাড়ি এবার দুই বাঙালির মালিকানাধীন। সম্প্রতি বৃদ্ধ মার্কিন মালিকের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নিয়েছেন কাজল মুখোপাধ্যায় ও মৌসুমী দত্তরায় নামের দুই প্রবাসী বাঙালি।

লন্ডন থেকে রবীন্দ্রনাথ নিউ ইয়র্ক শহরে পৌঁছেছিলেন ১৯১২ সালের ২৭ অক্টোবর। সেখান থেকে যান শিকাগোয়। কিন্তু এই যাত্রাপথে আমেরিকার জীবন যেন অসহ্য মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের। ইংল্যান্ডের কবিবন্ধু ইয়েটসকে চিঠিতে লিখেছেন সেই কথা। তবে ৭ নভেম্বর আর্বানাতে পৌঁছে মন ভালো হয়ে যায় তাঁর। এখানে সম্পদের প্রাচুর্য কম, কিন্তু জীবনের প্রাচুর্য অনেক বেশি। এমনটাই মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। এবারের সফরে সঙ্গে রয়েছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ। কিছুদিন আগেই প্রতিমাদেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়েছে রথীন্দ্রনাথের। তিনিও সঙ্গে এসেছেন। যদিও রথীন্দ্রনাথের কাছে এই জায়গা একেবারেই অপরিচিত নয়। ১৯০৬ সালেই তিনি এখানে এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করা। সেকালে এও এক ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। বাঙালি অভিজাতরা তখন পড়াশোনা করতে সাধারণত ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়েই যেতেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্রকে পাঠালেন ইলিনয়ে। রবীন্দ্রনাথ তখন পতিসরে তৈরি করেছেন কৃষিব্যাঙ্ক। কিন্তু বুঝেছিলেন, শুধু আর্থিক সাহায্য পেলেই কৃষকের উন্নতি সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে তাদের উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গেও পরিচয় ঘটাতে হবে। আর তাই রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে পাঠালেন।

১৯০৯ সালে পড়াশোনা শেষ করে ভারতে ফিরেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ট্রাকটর থেকে শুরু করে উন্নত সারের ব্যবহার, সবই তখন শেখাচ্ছিলেন কৃষকদের। সম্ভবত রথীন্দ্রনাথের অনুরোধেই একবার আমেরিকা যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিছক ভ্রমণপিপাসু হিসাবে আর্বানা গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ইলিনয়েস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক এল তাঁর বক্তৃতা শোনানোর। ভারতীয় দর্শণের পাশাপাশি মার্কিন ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতির কড়া সমালোচনাও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই সময় রসিকতা করে কবি লিখেছিলেন— ক্যান্ডি এবং চকোলেটের মতোই বক্তৃতা আমেরিকাবাসীর খুবই প্রিয়। তাঁর ভয় হচ্ছে, পাছে তাঁর পিছনেও পড়ে থাকেন আমেরিকাবাসী। আর সেই ভয় যে অমূলক নয়, তাও বোঝা গেল কিছুদিনের মধ্যেই। মাত্র ৬ মাস আর্বানায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি সম্মেলনে তাঁকে ডাক দেওয়া হয় বক্তৃতার জন্য।

আর্বানা শহরের এই বাড়িতে বসেই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের প্রুফ দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ইয়েটস এবং অন্যান্য বহু খ্যাতনামা ব্যক্তির সঙ্গে চিঠি আদানপ্রদান করেছেন এখানে বসে। এরপর আবারও ১৯১৬ সালে আমেরিকায় এলেন তিনি। তখন অবশ্য তিনি শুধু প্রাচ্যের একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত নন। তিনি এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী। এবং তিনি তখন নাইট উপাধিপ্রাপ্ত স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য সারা আমেরিকা উৎসুক হয়ে আছে। তবে এবারেও রবীন্দ্রনাথ প্রথম গিয়ে উঠলেন আর্বানার সেই বাড়িটিতেই। প্রায় ৯ দিন ছিলেন সেখানে। আমেরিকার অন্য কোথাও এত দীর্ঘ সময় থাকেননি রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বারের আমেরিকা ভ্রমণের সময় ইউরোপজুড়ে চলছে প্রথম মহাযুদ্ধ। আমেরিকা সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লেও যুদ্ধের আঁচ টের পাচ্ছে যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতায় তখন শোনা গেল যুদ্ধের বিরোধিতা এবং জাতীয়তাবাদের বিরোধিতাও। জাতীয়তাবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেনি ইতালি, জাপানের মতো বহু দেশের মানুষ। এমনকি খোদ কলকাতা শহরেও তরুণদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন তাঁর এই মতের জন্য। কিন্তু আমেরিকার মানুষ তাঁর এই বক্তব্যের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। আর্বানা ভিলেজের যে গির্জাটিতে প্রথম বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটি পড়ে ন্যাশনাল হিস্টোরিক্যাল বিল্ডিং হিসাবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। চানিং-ম্যুরে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় টেগোর ফেস্টিভ্যাল। ইলিনয় শহরের এবং আশেপাশের সমস্ত বাঙালির কাছে এই উৎসব বছরের শ্রেষ্ঠ উৎসব।

টেগোর ফেস্টিভ্যালের সময় প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটির দিকে তাকিয়ে থাকতেন কাজল-মৌসুমী। ১৯০৩ সালে তৈরি বাড়িটিতে বয়সের ছাপ পড়েছে। একেবারে ভেঙে পড়ার কোনো চিহ্ন যদিও নেই। বাড়ির মালিক স্ট্যান শার্লো নিজেও রবীন্দ্রনাথের উপর যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বাড়িটিকে সুন্দর করে রাখার কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি। আর তাই শেষ পর্যন্ত তাঁরাই কিনে নিলেন বাড়িটি। এখানে একটি আর্কাইভ ও মিউজিয়াম তৈরির ইচ্ছা আছে বলেও জানিয়েছেন তাঁরা। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বাড়িটির সংলগ্ন রাস্তার নাম রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গ করার প্রস্তাবও রেখেছেন তাঁরা। কাজল-মৌসুমীর হাত ধরে নতুন করে প্রাণ পেতে চলেছে রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা ভ্রমণের ইতিহাস।

তথ্যসূত্রঃ Rabindranath Tagore and America, ANANDASAMBAD, NEW JERSEY
On Tagore’s Trails in America, Sugato Mukherjee, India Currents
Tagore in Urbana, Illinois, Harold M. Hurwitz
Tagore in America (Sepia Mutiny guest post), Amardeep Singh
আমেরিকায় কবিগুরুর স্মৃতির বাড়ি কিনলেন দুই বাঙালি, রবীন্দ্রনাথ সত্যিই যেখানে থেকেছিলেন, উজ্জ্বল চক্রবর্তী, আনন্দবাজার পত্রিকা
RABINDRANATH TAGORE IN URBANA, Annual Tagore Festival in Urbana

Powered by Froala Editor

More From Author See More