রক্তক্ষয়ী আন্দোলন, নাকি ‘গ্রীষ্মকালীন ছুটির অবসর’? বিপ্লবের অন্য নাম ‘মে-৬৮’

প্যারি কমিউন বিপ্লব বা ১৯১৭ সালের অভ্যুত্থানে সামিল হয়েছিলেন কেবল শ্রমজীবী মানুষ। তাঁরা ততদিনে জেনে গিয়েছেন, মানুষের জীবনের মূল্য রাষ্ট্রের কাছে কতটুকু। তাঁরা মানিয়ে নিতেই অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালের মে মাসে প্যারিস শহর যে অভ্যুত্থানের সাক্ষী ছিল, তার সূত্রপাত হল তথাকথিত বুর্জোয়া শ্রেণির মানুষদের মধ্যে থেকেই। তাঁরা রাষ্ট্রের অত্যাচার সহ্য করতে অভ্যস্ত ছিলেন না। প্রতিটা জীবনের মূল্য তাঁদের কাছে অপরিসীম। আর সেই কারণেই বোধহয় ১৯৬৮ সালের মতো অভ্যুত্থান প্যারিস শহরে আর কোনোদিন ঘটেনি। মে-৬৮ অভ্যুত্থানের ৫০ বছরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, ঠিক এইভাবেই তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন ন্যাশানাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের ইতিহাস গবেষক ফিলিপ আর্টিয়ারিস।

ঘটনার সূত্রপাত প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাতের ক্যাম্পাস থেকে। তবে এই আন্দোলন যেন শুধুই ছাত্র আন্দোলন নয়। দেখতে দেখতে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল শ্রমিকদের মধ্যে। একদিকে নাতের ক্যাম্পাস দখল করে রেখেছেন অসংখ্য পড়ুয়া এবং অধ্যাপক-অধ্যাপিকা। নাতের ক্যাম্পাসের কাছেই বিখ্যাত গাড়ি নির্মাতা সংস্থা রেনল্টের কারখানা। কারখানা কর্তৃপক্ষ আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামাননি। কারণ এ তো পড়ুয়াদের বিষয়। তবে আন্দোলনে সামিল শ্রমিকরাই রাতারাতি দখল করে নিল রেনল্ট কারখানা। অবশ্য উৎপাদন বন্ধ হয়নি। শ্রমিকরা নিজেরাই এগিয়ে নিয়ে চললেন কারখানার কাজ। বন্ধ হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠনও। কোথাও কোনো অধ্যাপককে ঘিরে বসে বিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ বুঝছেন পড়ুয়ারা। কোথাও এক ছাত্রের গিটারে বেজে উঠছে নতুন ধারার রক মিউজিক। আর সেই সুরের মূর্ছনা থামতেই শুরু হয়ে গেল সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা। আজও সেইসব দিনের কথা ভাবলে রোমাঞ্চিত হন প্যারিসের মানুষ।

১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে ফ্রান্সের সংবাদপত্র ‘লে মন্ডে’ একটি প্রতিবেদনে লেখে, প্যারিসের যুবসমাজ সমস্ত তেজ হারিয়ে ফেলেছে। আমেরিকা, পশ্চিম জার্মানিতে তখন নতুন নতুন রাজনৈতিক দাবি নিয়ে হাজির হচ্ছেন যুবক যুবতীরা। উঠে আসছে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রসঙ্গ। কিন্তু ফ্রান্সের তরুণ প্রজন্ম সব বিষয়েই নিশ্চুপ। এই প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক ৬ সপ্তাহের মধ্যেই ঘটে গেল ‘অঘটন’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে ছাত্র এবং ছাত্রীদের মেলামেশা কমিয়ে আনার জন্য বেশ কিছু নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। আর এর পরেই তরুণ ছাত্রনেতা কোন-বেন্ডিটের নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলেও ক্রমশ তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে আরও নানা সামাজিক দাবিদাওয়া। যে ফরাসি সমাজে খাবার টেবিলে গৃহকর্তার অনুমতি ছাড়া মুখ খুলতে পারতেন না মহিলারা, সেখানেই উঠে এল সমকামী মানুষদের অধিকারের প্রশ্নও। তবে আন্দোলনের মূল অক্ষ ছিল শিক্ষাব্যবস্থা। ক্লাসরুমের পঠনপাঠনের নিয়মকে ঘিরেই প্রশ্ন তুলেছিলেন আন্দোলনকারীরা। বিজ্ঞানের পড়ুয়ারা অনায়াসে এগিয়ে আসছেন সমাজবিজ্ঞানের বিষয় বুঝতে। আবার কলাবিভাগের পড়ুয়াদের তাঁরাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন জটিল গাণিতিক সমীকরণ। কার্যত নাতের ক্যাম্পাসকে ঘিরে মুক্তাঞ্চল তৈরি করে ফেললেন তাঁরা।

ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি বিগত ১০ বছর ধরে প্রাসঙ্গিকতার আড়ালে চলে গিয়েছিল। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও সেভাবে জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না। চার্লস ডি-গলের নেতৃত্বে কার্যত একনায়কত্ব চলছিল ফ্রান্স জুড়ে। ঠিক এই সময় নাতের ক্যাম্পাসের আন্দোলনে উঠে এল চে গুয়েভারা, মাও-সে-তুঙের ছবি। দাবি উঠল ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের। ২ মে শুরু হওয়া এই আন্দোলন যে খুব তাড়াতাড়ি সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, সেটা বুঝতে সময় নেননি ডি-গল। ১০ মে রাতে বিরাট সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের উপর। শুরু হল খণ্ডযুদ্ধ। রাতভোর সংঘর্ষে অন্তত ৩০০ জন পড়ুয়া আহত হলেন। গ্রেপ্তার হলেন কোন-বেন্ডিট সহ ৫০০ জন পড়ুয়া। তবে এতদিন ধরে আন্দোলনকারীরা ধীরে ধীরে যে জনসমর্থন পেয়েছিলেন, তাই জনস্রোতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল প্যারিসের রাজপথে।

আরও পড়ুন
স্বদেশি আন্দোলন, বেঙ্গল ইমিউনিটি ও ‘ক্যাপ্টেন’ নরেন্দ্রনাথ দত্তের গল্প

এরপর প্রায় গোটা মে মাস ধরে প্যারিস শহরজুড়ে যেন ‘গ্রীষ্মকালীন ছুটির আবহাওয়া’। হ্যাঁ, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকেও এভাবেই দেখতে চেয়েছেন ফিলিপ আর্টিয়ারিস। আর হবে নাই বা কেন? তথাকথিত রাজনৈতিক পরিসরের বাইরে গিয়ে যেন অন্য এক বাস্তবতার কথা উঠে এসেছিল আন্দোলনজুড়ে। আন্দোলনের স্লোগান থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। কয়েকটার কথা ধরা যাক। ৩০-এর দশকে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় জনপ্রিয় স্লোগান হিসাবে উঠে এসেছিল ‘অল পাওয়ার টু দ্য প্রোলেতারিয়েত’। আর মে-৬৮ আন্দোলন শোনাল, ‘অল পাওয়ার টু দ্য ইমাজিনেশন’। না শ্রমিক শ্রেণির বিরোধিতা করে নয়, বরং তাঁরাও পথে নেমেছিলেন সেই কল্পজগতের উদ্দেশে। কোথাও আবার পাথরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রসৈকত খুঁজছেন শ্রমিকরা। বলছেন, ‘বিনেথ দিজ পেভিং স্টোনস, দেয়ার ইজ দ্য বীচ’। অথবা স্লোগান হয়ে উঠে আসছে একটিমাত্র শব্দ, ‘কুইক’। সভ্যতা যে শেষ হয়ে আসছে। একটু দ্রুত এগোতে হবে সবাইকে।

ছাত্রসমাজের এই আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির ভূমিকার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। পড়ুয়ারা যেমন ক্লাসরুমের নিয়ম ভেঙেছিলেন, তেমনই কারখানার নিয়ম ভেঙেছিলেন শ্রমিকরা। রেনল্ট কারখানায় শ্রমিকদের কেউ বানাতেন গাড়ির বনেট, কেউ ইঞ্জিন, কেউ বা টায়ার-টিউব। কেউই সম্পূর্ণ একটা গাড়ি বানাতে জানতেন না। মে-৬৮ আন্দোলন প্রত্যেককে সবকিছু বানাতে শিখিয়েছিল। আসলে গোটা কারখানাটাই যে তাঁদের। শুধু তাই নয়, রেস্টুরেন্ট-ক্যাফেতে ওয়েটাররা জানিয়ে দিলেন তাঁরা কারোর থেকেই টিপস নেবেন না। কেনই বা নেবেন? কাজ করে পারিশ্রমিক নেবেন। কারোর দয়া দাক্ষিণ্যের প্রয়োজন তো তাঁদের নেই। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে যে আধুনিকতার জন্ম হচ্ছিল, এতদিন তা মানুষের জীবনকে ছুঁতে পারেনি। ১৯৬৮ সালে ফ্রান্স প্রকৃত আধুনিকতার মুখে দাঁড়াল। হয়তো আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক দিশা ছিল না। যা ছিল, তা হল পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ জানানোর স্পর্ধা।

আরও পড়ুন
১ নভেম্বর, বাংলাকে ঘিরে পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন জন্ম দিয়েছিল পুরুলিয়ার

মে মাসের শেষ থেকেই অবশ্য নানা জটিলতা শুরু হয়ে যায় আন্দোলনকে ঘিরে। একদিকে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের সঙ্গে মধ্যস্থতার চেষ্টা করতে থাকে। অবশ্য শ্রমিকরা তখন ট্রেড ইউনিয়ন ভেঙে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডি-গল ততক্ষণে পশ্চিম জার্মানি থেকে সামরিক সাহায্য লাভের আশায় বাডেন-বাডেন শহরে পৌঁছে গিয়েছেন। ফিরে এসে একের পর এক কূটনৈতিক চালে ভেঙে দিলেন আন্দোলন। জুন মাসে সাধারণ নির্বাচনের দিন স্থির হল। ডি-গলের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হলেও বিকল্প নেতৃত্ব ছিল না। তাই আবারও জয়লাভ করলেন তিনিই। পুণরায় ক্ষমতায় এসেই একের পর এক দমনমূলক আইন চাপাতে শুরু করলেন। তার বেশিরভাগই অবশ্য ব্যর্থ হয়। আধুনিকতার স্রোত তখন গোটা দেশের ধমনীতে বইতে শুরু করেছে। সেই স্রোত ঢুকে পড়েছে বাড়ির অন্দরমহলেও। মূল লড়াই তো ছিল পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ফরাসি মহিলারা বুঝলেন, সমাজকে বোঝালেন, তাঁরা পুরুষের ক্রীতদাস হওয়ার জন্য জন্মাননি। বরং পুরুষ-মহিলাদের মধ্যে গড়ে উঠতে শুরু করল স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আজকের ইউরোপের দিকে তাকালে এসব নিতান্ত স্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে এটুকুর জন্যই তো কম রক্ত ঝরেনি। অন্তত ১ কোটি মানুষকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালের প্যারিস শহর বুঝিয়ে দিয়েছিল, রাস্তাই একমাত্র রাস্তা।

তথ্যসূত্রঃ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা
মে ১৯৬৮ঃ আ মান্থ অফ রেভোলিউশন পুট ফ্রান্স ইনটু দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড, আলিশা জে. রুবিন, নিউইয়র্ক টাইমস

Powered by Froala Editor

More From Author See More