মহিলা শিল্পীদের কি প্রদর্শনীতে উলঙ্গ হয়ে ঢুকতে হবে? প্রশ্ন তুলেছিলেন গেরিলা গার্লরা

রাতের অন্ধকারে নিউ ইয়র্ক (New York) শহরের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েকজন তরুণী। তাঁরা প্রত্যেকেই এক একজন শিল্পী (Artist)। তবে কী তাঁদের আসল পরিচয়, তা জানা নেই। প্রত্যেকের মুখ ঢাকা গরিলা মুখোশে। হাতে পোস্টারের কাগজ, আঁঠা। কারোর হাতে আবার স্প্রে রঙের ক্যান। শহরজুড়ে তাঁরা এঁকে চলেছেন তাঁদের প্রতিবাদের ভাষা। আড়ালে থেকে আক্রমণ করে চলেছেন শিল্পের প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে। তাঁরা এক একজন গেরিলা। আবার মুখের গরিলা মুখোশের মধ্যেও যেন সেই শব্দটারই একটা সাদৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে চান। পোস্টারে লেখা বয়ানের নিচে নামগুলোও বেশ অদ্ভুত। কারোর নাম ফ্রিদা কাহলো, কেউ কোলটউইজ। যাঁরা প্রত্যেকেই পূর্ববর্তী প্রজন্মের এক একজন প্রথিতযশা মহিলা শিল্পী। অবশ্য এগুলো যে ছদ্মনাম, তা বলাই বাহুল্য। ক্রমশ শহরের বুকে গেরিলা গার্ল (Guerrilla Girls) নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন তাঁরা। বিগত ৪ দশক ধরে শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলিকে একইভাবে আক্রমণ করে চলেছেন এই গেরিলা গার্লরা।

সময়টা ১৯৮৪ সাল। নিউ-ইয়র্ক শহরের বুকে আয়োজিত হয়েছে একটি শিল্প প্রদর্শনী। সমস্ত ধরনের শিল্পীদের সমান সুযোগ করে দেওয়াই এই প্রদর্শনীর মূল উদ্দেশ্য। এমনটাই বলেছিলেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু কোথায় কী? দেখা গেল বাস্তবে গোটা প্রদর্শনীজুড়ে শুধু সাদা চামড়ার পুরুষ শিল্পীদের রমরমা। ১৬৫ জন শিল্পীর কাজের মধ্যে মহিলা শিল্পী রয়েছেন মাত্র ১০ জন। অর্থাৎ মোটামুটি ৪ শতাংশ। এই ঘটনাই তৈরি করে দিল আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। প্রদর্শশালার সামনে হঠাৎ গভীর রাতে কেউ বা কারা সেঁটে দিয়ে গেলেন একটি প্রতিবাদী পোস্টার। তাতে আঁকা একটি নারীশরীর। তবে তার মুখ বোঝা যাচ্ছে না। কারণ মুখের জায়গায় রয়েছে একটি গরিলার মুখোশ। আর নগ্ন শরীরের ছবিটার পাশে লেখা বয়ানটিতে প্রশ্ন করা হয়েছে, প্রদর্শনীতে প্রবেশ করতে গেলে কি মহিলা শিল্পীদের পোশাক খুলে ফেলতে হবে?

শুরুর দিকে অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন এই আন্দোলনের সঙ্গে। একটা সময় ৩০ জনেরও বেশি সদস্য ছিল এই দলে। তবে মাঝে অনেকেই গেরিলা গার্লদের সঙ্গ ত্যাগ করে চলে গিয়েছেন। অবশ্য এই নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই ফ্রিদা কাহলো বা কোলটউইজদের। তাঁরা মনে করেন, আন্দোলনের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁরাই রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন শিল্পের জগতে প্রত্যেক বর্গের, বিশেষত মহিলাদের সুযোগের অভাব রয়েছে। সেখানে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে জায়গা পাওয়ার পর এই দল ছেড়ে গিয়েছেন। আবার কেউ মনে করেছেন, যতদিন শিল্প থেকে শিল্পীর পরিচয়ের গন্ধ মুছে না যাবে ততদিন সমাজের যাবতীয় বিদ্বেষ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও থাকবে। তাই তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচয় মুছে ফেলে শিল্পী পরিচয়কেই মুখ্য করে তুলেছেন।

ফ্রিদা কাহলোর কথায়, এখনও শিল্পীদের শেষ ঠিকানা প্রদর্শশালা। এখনও সবাই মনে করেন, প্রদর্শশালায় জায়গা পাওয়াই একজন শিল্পীর সার্থকতা। অথচ শিল্পের সার্থকতা তো মানুষের সামনে নিজেকে মেলে ধরায়। আর সবচেয়ে বেশি মানুষ যেখানে থাকেন, সেই রাজপথই শিল্পের শ্রেষ্ঠ জায়গা। তাই ৪ দশক ধরে তাঁরা রাজপথেই রয়েছেন। অন্যদিকে কোলটউইজ আন্দোলনের অন্য একটি দিকের কথাও তুলে ধরেন। আমেরিকায় নারীবিদ্বেষের চেয়েও গুরুতর সমস্যা বর্ণবিদ্বেষ। আর সেই বিষয়টাকে সামনে আনতেই গরিলা মুখোশ ব্যবহার করেন তাঁরা। সাদা চামড়ার মানুষের বিদ্রুপের ভাষা থেকেই তো গরিলা এবং কৃষ্ণাঙ্গ সমার্থক হয়ে উঠেছে।

আমেরিকাজুড়ে আজও সমান জনপ্রিয় গেরিলা গার্লদের কাজ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে তাঁদের। শিল্পীদের শ্লেষাত্মক বিদ্রুপগুলোই মানুষকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। আর সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানও কি নড়ে ওঠে না? এর মধ্যেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা উদ্যোগ শুরু হয়েছে মহিলা শিল্পীদের জন্য। এই সব উদ্যোগই নিজেদের সাফল্য বলে মনে করেন গেরিলা গার্লরা। পাশাপাশি তাঁরা মনে করেন, এখানেই শেষ নয়। সামনে আরও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি।

Powered by Froala Editor

More From Author See More