সলিলের সঙ্গে এক সোফায় নয় কিছুতেই, মাটিতে বসে গান শিখলেন কিশোরকুমার

রবীন্দ্রসংগীতের দুই কিংবদন্তি শিল্পী। সলিল চৌধুরীর গান দু'জনকেই ফেলেছিল বিপদে। 

শান্তিনিকেতনে বেড়ে ওঠা এঁদের একজনের  গাওয়া প্রথম রেকর্ডের গানদুটো কিন্তু মোটেই রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়, ছিল আধুনিক গান। ১৯৩৮ সালে বেরোনো ওই রেকর্ডে নীহারবিন্দু সেনের কথায় আর হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে তিনি গেয়েছিলেন ‘ওরে ওই বন্ধ হল দ্বার’ আর ‘গান নিয়ে মোর খেলা’। রবীন্দ্রনাথ তখনও জীবিত। সেই  ঘটনায় নাকি কবি একটু দুঃখ পেয়েছিলেন। সেই শিল্পীর  ভাষায়, ‘আমার আধুনিক গানের রেকর্ড বের হওয়ায় দুঃখ পেলেন গুরুদেব। ...গুরুদেব দুঃখ পাওয়ায় আমারও মন খারাপ হয়ে গেল।’ কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি তিনি। কিন্তু ঘটনাটা  ঘটল রবির অস্তের বেশ ক'বছর পর। 

আরও পড়ুন
মনোমালিন্য চরমে, সুচিত্রা মিত্রের থেকে এক টাকা হলেও বেশি পারিশ্রমিক চাইলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

'৫২-৫৩ সাল। সেই শিল্পী রেকর্ডিংয়ের জন্যে এলেন কলকাতায় এইচএমভি স্টুডিওতে। রিহার্সাল রুমে সলিল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা। মুখোমুখি পরিচয় সেই প্রথম।  সলিলের গান তাঁর ভীষণ  প্রিয়।  তিনি বলেই ফেললেন, সলিলের গান গাইতে তাঁর খুব ইচ্ছে করে। তা শুনেই সলিল চৌধুরী দিন দুয়েকের মধ্যেই তাঁর  জন্যে দুটো গান বেঁধে  ফেললেন। রেকর্ডিংও হয়ে গেল। এর পরেই ঝামেলা।

রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সঙ্গীতপ্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন, এতে আমার সন্দেহ নেই।

খবর গেল শান্তিনিকেতনে। শিল্পী  লিখেছেন, ‘সলিলের গান করেছি, এ খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছল যথারীতি। অনেকে আপত্তি করলেন, কেন আমি রবীন্দ্রনাথের গান ছেড়ে আবার আধুনিক গান গাইব? রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়লাম কোথায়! সে গান তো আমার সারাজীবনের আশ্রয়। কিন্তু তর্কে আমি কুঁকড়ে যাই। লড়াই চালাতে ইচ্ছে করে না। ফলে আপত্তি মেনে নিলাম। সলিলকে জানালাম, বের করা যাবে না ওই রেকর্ড। দুঃখ পেয়েছিল সলিল। আমিও কম দুঃখ পাইনি।’ শেষে উৎপলা সেনকে দিয়ে রেকর্ডে গাওয়ালেন সলিল চৌধুরী। ১৯৫৩ সালের পুজোয় প্রকাশিত সেই দুই গান হল ‘প্রান্তরের গান আমার’ আর ‘আমার কিছু  মনের আশা’। 
‘চোখের জলে অর্ধেক মুছে যাওয়া একটি চিঠিতে’ শিল্পী সলিল চৌধুরীকে লিখেছিলেন, ‘কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তোমার গান গাইলে আমাকে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হবে। কাজেই আমাকে ক্ষমা কোরো ভাই।’

শিল্পীর নাম?  কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

সুচিত্রা মিত্রের সঙ্গেও ঘটেছিল প্রায় অনুরূপ ঘটনা।
শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সুচিত্রা ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’-র সঙ্গে যুক্ত হ'লে সেখানেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। 

'৫০-এ সলিলের কথায়-সুরে সুচিত্রা রেকর্ডে গাইলেন ‘সেই মেয়ে’। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার কৃষ্ণকলি পরবর্তীতে দেশভাগের কবলে পড়ে কী অবস্থায় পৌঁছেছে, তার আন্তরিক চিত্র এঁকেছিলেন সলিল চৌধুরী ‘সেই মেয়ে’ গানে। সেই গান নিয়েও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তার উল্লেখ আছে  সুচিত্রা মিত্রের ‘পুরনো আখরগুলি’ নামে লেখায়। তিনি লিখেছেন, এ গান বেরোনোর পর ‘রবীন্দ্রভক্ত’রা তাঁকে ‘আক্রমণ করলেন’, ‘অপমান করলেন’, তাঁর সামনে গানের ডিস্ক ভাঙাও হল। কারণ হিসেবে লিখেছেন, ‘আমি কেন এক দাগি কমিউনিস্টের পাল্লায় পড়ে রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির parody  গাইলাম।’ তাঁর বক্তব্য, ‘আমি সেদিনও বলেছি, আজও বলছি— “সেই মেয়ে” কৃষ্ণকলির parody নয়। সলিলের প্রতিভাকে আমি ঠিকই চিনেছিলাম। ওঁরাই চেনেননি। ...রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সঙ্গীতপ্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন, এতে আমার সন্দেহ নেই।’

আরও পড়ুন
রাতের কলকাতায় ছুটে চলেছে জর্জ বিশ্বাসের 'পক্ষীরাজ' বাইক

বাঙালিকে ভাসানোর পর ৬০ সাল নাগাদ সলিল চাইলেন মুম্বই যেতে।
সেরকম এক সকালেই এল টেলিফোন। ওপার থেকে এক কণ্ঠ - ‘‘ঠিক আছে, চলে আসুন।’’ তিনি স্বয়ং বিমল রায়! বম্বে টকিজ-এর কর্ণধার। 

সলিলকে অবাক করে তিনি বললেন গানের জন্য নয়,  সলিলের লেখা গল্প ‘রিক্সাওলা’ পড়ে খুব পছন্দ হয়েছিল বিমলবাবুর। ঠিক হ'ল ছবির নাম হবে ‘দো বিঘা জমিন’। চিত্রনাট্য লিখবেন সলিলই। কিন্তু  ছবির সুরকার হিসেবে ভেবেছিলেন অনিল বিশ্বাসকে। সহকারী পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় মাঝখান থেকে বললেন, ‘‘বিমলদা, এ ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য যখন সলিলের, তখন সুর করার দায়িত্ব ওকেই দিন না কেন?’’
রাজি হয়ে গেলেন বিমলদা। সেই সূত্রেই মোহন স্টুডিয়োতে আলাপ মান্না দে’র সঙ্গে। মান্না দে বুঝেছিলেন, এ-ছেলে অনেক দূর যাবে!

কথা লিখলেন শৈলেন্দ্র। সুর সলিলের। ব্যস! ‘দো বিঘা জমিন’-এর গান হিট— ‘ধরতি কহে পুকার কে, বীজ বিছা লে প্যার কে, মৌসম বিতা যায়’ আর ‘হরিয়ালা সাবন ঢোল বজাতা আয়া’।
‘দো বিঘা জমিন’-এর সুর মাতিয়ে দিল বম্বেকে। লোকের মুখে মুখে তখন ‘মৌসম বিতা যায় মৌসম বিতা যায়’। অলটাইম হিটের তালিকায় চলে গেল ‘দো বিঘা জমিন’।

সঙ্গীতের ব্যকরণ গুলে খেয়েছিলেন তিনি। তিনি যখন মোৎসার্টের সিম্ফনি ব্যবহার করছেন, তখন ২/৪-কে পাঁচ মাত্রায় ফেলে লয় কিছুটা বদলাচ্ছেন। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গলায় 'ঝনন ঝনন বাজে' কিংবা শ্যামল মিত্র-সবিতা চৌধুরীর ডুয়েট 'ডেকোনা মোরে ডেকো না গো আর' বানাচ্ছেন কলাবতী রাগে। শিবরঞ্জনী রাগে বানিয়েছেন 'ধরণীর পথে পথে আমিও পৌঁছে যাব'। চ্যাপলিনের 'লাইমলাইট' এর মুক্ত ছন্দের মূল সুরকে ৪/৪ ষোলমাত্রায় ফেলে সলিল বানান 'পল্লবিনী'। 

সলিল প্রথম জীবনে পশ্চিমী আঙ্গিকে ধ্রুপদী আর শেষ জীবনে তৎকালীন রক পপ ঘরানার অনুসারী। ঘন স্ট্রিংস আর বাঁশির বুনিয়াদে তাঁর ইমারত। নিউ ইয়র্কের এক জ্যাজ ক্লাবে এক জ্যাজ সঙ্গীতকারকে জ্যাজের কর্ড প্রোগ্রশন নিয়ে এমন ফান্ডা দিয়েছিলেন সলিল যে তিনি স্বীকার করেন এমন ফান্ডাবাজ সঙ্গীতজ্ঞ জীবনে দেখেননি।

দক্ষিণ ভারতে তিনি ছিলেন  ‘মিউজিক গড’। বম্বেতে স্টুডিও যাওয়ার পথে এক জায়গায় জুতো পালিশ করাতেন সলিল। পালিশওলার ছেলেও বসত তার বাবার পাশে। তাঁর নাম পান্ডুরং।
একটা ভাঙা ম্যান্ডোলিন বাজাত পান্ডুরং। সলিল তার আগ্রহ দেখে তাকে নতুন একটা ম্যান্ডোলিন কিনে দিলেন। যত্ন করে তাকে শিখিয়েওছিলেন।  তাকে নিজের মিউজিক ইউনিটের সদস্যও করে নেন।
‘পরখ’ ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের ‘মিলা হ্যায় কিসিকা ঝুমকা’ গানের সঙ্গে পান্ডুরংই ম্যান্ডোলিন বাজিয়েছিল। তার অকালমৃত্যু ঘটে।

আমাকে মাফ করুন সলিলদা, আপনার সমান উচ্চতায় বসে আমি এ গান শিখতে পারব না। কী সুর করেছেন!

তিনি নাকি ছিলেন খুব ফাঁকিবাজ, আলসে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অনুযোগ করে বলেছিলেন তাঁকে ঘরে আটকে রাখা দরকার একাগ্রতার জন্য। কিন্তু যাঁরা সলিলকে চিনতেন, বিলক্ষণ জানতেন সুর একবার এসে গেলে আটকায় কার সাধ্যি!

 শচীনকত্তা একদিন বলেছিলেন ‘জানস, আমার সুর মনে ধরে না আমার পোলাডার। ও পাগল তর সুরে। বার বার শুইনতে থাকে তর গান। আমারে ও মানে না। পারিস তো এট্টু বোঝাস পঞ্চমরে।’
ছেলে পঞ্চম ছিল সলিলের অন্ধ ভক্ত। রেকর্ডিংয়ের সময়ে চলে আসত স্টুডিয়োয়। খুঁটিয়ে দেখত মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট। রেকর্ডিংয়ের পরও ছাড় নেই। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। 

সবিতা চৌধুরীর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় কিশোর কুমারকে নিয়ে এক মজার গল্প -

" ‘অন্নদাতা’ ছবির গান বেঁধেছেন। শোনাবেন বলে।
মুখ গম্ভীর করে সলিলের পাশের সোফায় বসলেন কিশোরদা। খুব মন দিয়ে সুর শুনতেন উনি।
সোফায় বসে সলিল হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শোনাচ্ছেন, ‘গুজর গয়ে দিন দিন দিন কি/ হর পল গিন গিন গিন/ কিসিকি হায় ইয়াদোঁ মে’।
শেষ লাইনটি শুনেই ধপাস করে মাটিতে বসে পড়লেন কিশোরদা।।
‘‘কী হল, কী হল?’’ আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন সলিল। তখনও মাটিতে থেবড়ে বসে কিশোরদা। মুখ নিচু। মাথা তুলে হাত জোড় করে বললেন, ‘‘আমাকে মাফ করুন সলিলদা, আপনার সমান উচ্চতায় বসে আমি এ গান শিখতে পারব না। কী সুর করেছেন!’’
এর পর বাকি সময়টা মাটিতে বসেই গান শিখেছিলেন কিশোরদা!"