নামান্তরের অন্তরে

মানিকলমকারি - ৫৭
আগের পর্বে

সত্যজিৎ রায় ছোটদের জন্য সিনেমা তো বানিয়েছেন, তার সঙ্গে লিখেছেন গল্প, উপন্যাস এবং ছড়াও। কিন্তু নাটক লেখেননি সেই অর্থে। যদিও একটি ছোটো নাটিকা তিনি লিখেছিলেন ১৯৮৬ সালে। ‘হাউই’ নামের সেই নাটিকা কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৪ সালে সেটি ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় স্থান পায়। নাটিকাটির গঠনও শুরু থেকেই বেশ অন্যরকম। চরিত্রগুলির অবস্থানের পাশাপাশি কে কী করছে তারও নিখুঁত বর্ণনা লিখেছেন সত্যজিৎ। ‘হাউই’ নামে একটি শিশুসাহিত্য পত্রিকার অফিসকে ঘিরে কাহিনি। পরে সত্যজিৎ একই কাহিনি নিয়ে লিখবেন ‘শিশুসাহিত্যিক’ নামে একটি ছোটোগল্প। চরিত্রগুলোর নাম বদলে যাবে। কিন্তু নাটিকাটি কেন তিনি প্রকাশ করলেন না, এর উত্তর হয়তো আর জানা যাবে না।

রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পের নায়কের নামটাই বদলে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ‘সমাপ্তি’ গল্পটির শুরুর লাইনটি ছিল এই রকম, ‘অপূর্বকৃষ্ণ বি-এ পাস করিয়া কলিকাতা হইতে দেশে ফিরিয়া আসিতেছেন।’ যাঁরা রবীন্দ্রনাথের লেখা কাহিনিটি পড়েছেন, তাঁরা জানেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম ওই অংশের প্রায় হুবহু চিত্ররূপই প্রতিফলিত হয়েছিল সত্যজিতের চিত্রনাট্যে। তবে আশ্চর্য ঘটনা এটাই যে, রবীন্দ্রানথের ‘অপূর্বকৃষ্ণ’ সত্যজিতের ছবিতে হল ‘অমূল্য’। সত্যজিৎ এই ‘তিন কন্যা’ ছবিতেই আরো নামান্তর ঘটিয়েছেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের ওই পোস্টমাস্টার চরিত্রটির কোনো নাম ছিল না--- সে ছিল শুধুই ‘পোস্টমাস্টার’। কিন্তু সত্যজিতের ছবিতে সেই উলাপুর গ্রামের পোস্টমাস্টারের নাম হল নন্দলাল। রবীন্দ্রনাথের গল্পে পোস্টমাস্টার চরিত্রের কোনো নাম-না-রাখাটা বেশ কৌতূহলপ্রদ একটা বিষয়। আসলে, যে চরিত্রটি কেবলমাত্র কাজের সূত্রেই যুক্ত হতে পারল গ্রামের সঙ্গে, গ্রামের ওই বালিকা রতনের সঙ্গে, তার আর নাম-পরিচয় কী হবে? নাম-পরিচয় তো ব্যক্তির নিজস্ব পরিচয়। ব্যক্তিগত ভাবে যে যুক্ত হতেই পারল না--- তার আর ব্যক্তিনাম কী করে উল্লিখিত হয় গল্পে? তাই বুঝি রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টারকে কেবল ‘পোস্টমাস্টার’ নামেই রাখলেন, কোনো ব্যক্তিনাম দিলেন না। অথচ সত্যজিৎ সেই চরিত্রের নাম দিয়েছিলেন নন্দলাল। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত যে কেউই বুঝবেন নন্দলাল শব্দের অর্থ কৃষ্ণ--- সেই কৃষ্ণ যিনি বৃন্দাবনে রাধাকে তাঁর জন্য উন্মাদিনী করে নিজে চলে গিয়েছিলেন মথুরায়। আর কোনোদিন ফিরে আসেননি বৃন্দাবনে। মনে হয়, সেই গল্পটাই কি ফিরিয়ে আনলেন এই নামকরণে! এর সঙ্গে আরেকটি যুক্তি ছিল সত্যজিতের দিকে। গল্পের বালিকা রতনের নামে কোনো যুক্তব্যঞ্জন নেই। ফলে তাকে পড়া শেখাবার সময়ে রতন লেখা সহজ হলেও, নন্দ লেখার জন্য যে যুক্ত ব্যঞ্জন জানা দরকার। সেই যুক্ত ব্যঞ্জন শেখার গল্পটাকেও যে রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিৎ দুজনেই দুইভাবে গল্পে ব্যবহার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, পোস্টমাস্টার রতনকে ‘লইয়া স্বরে অ স্বরে আ’ করে ‘অল্পদিনেই যুক্ত- অক্ষর উত্তীর্ণ হইলেন’। লক্ষণীয়, ‘যুক্তাক্ষর’ নয়--- ‘যুক্ত- অক্ষর’। রতনের হৃদয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারল না বলেই বুঝি তাঁর শেখানো যুক্তাক্ষরকেও রবীন্দ্রনাথ সন্ধি বিচ্ছেদ করেই বললেন ‘যুক্ত- অক্ষর’। সত্যজিতের চিত্রনাট্যেও এই প্রসঙ্গ এল--- একটু অন্যভাবে। রতনকে স্বরবর্ণ লেখা শিখিয়ে দেওয়ার পরে নন্দলাল তাকে বলে, ‘সোমবার থেকে যুক্তাক্ষর’। নতুন শব্দ শুনে রতনের জিজ্ঞাসা, ‘কী অক্ষর’। তার এই জিজ্ঞাসার উত্তরে নন্দ তার নামের বানান জিজ্ঞাসা করলে রতন বলে, ‘দন্ত্য-ন দন্ত্য-ন দ’। স্বরধ্বনি ব্যঞ্জনধ্বনি যে জানে, তার কাছে তো এই বানানই স্বাভাবিক বলা। সংলাপে যুক্তব্যঞ্জন ভেঙে এমন একটা শব্দ হওয়া দরকার, যার আবার একটা নিজস্ব অর্থ হয়। তাই বুঝি ওই ‘নন্দ’ নামটি বেছে নিলেন সত্যজিৎ তাঁর চিত্রনাট্যে।

রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে চিত্রনাট্য করার সময় আরো একবার চরিত্রের নাম বেছে নিতে হয়েছে সত্যজিৎকে। আর তা হল ‘চারুলতা’-য়। ‘নষ্টনীড়’ গল্পে চারুর দাদার নাম কী ছিল? ছবি যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের মনেই আছে, শ্যামল ঘোষাল অভিনীত সেই চরিত্রটির নাম ছিল উমাপদ। কিন্তু গল্পে? গল্পে ওই চরিত্রটির নাম কী? ভারি আশ্চর্যের একটি বিষয় কী, ‘নষ্টনীড়’ গল্প লেখা সময়ে রবীন্দ্রনাথ ভুলবশত একটিই চরিত্রের দুটি নাম লিখেছিলেন! কখনোই এমনটা হয় না তাঁর--- অথচ এই চরিত্রের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে গিয়েছিল। মূল ‘নষ্টনীড়’ গল্পে মোট তিনবার উল্লেখ আছে উমাপদ চরিত্রটির--- তার মধ্যে একবার উমাপদ বাকি দুইবার উমাপতি। সম্ভবত চারুর বরের নাম ভূপতি-র সঙ্গে সাদৃশ্য সরানোর জন্যই উমাপতি আর ভূপতি-র মধ্যে উমাপদ বেছে নিয়েছেন সত্যজিৎ। প্রসঙ্গত, ভূপতি চরিত্রের যে পদবি ‘দত্ত’ আর অমল চরিত্রের যে পদবি ‘বসু’--- সেটাও তো সত্যজিতের সংযোজন। এদের এই কায়স্থ পদবি বলেই লক্ষ করবেন, ‘সরোরুহ’ পত্রিকায় চারুলতা-র প্রকাশিত গল্পের শেষে তার নামে ‘চারুলতা দাসী’ শব্দটি লক্ষণীয়।       

কিন্তু কথাটা শুরু হয়েছিল যে, অপূর্বকৃষ্ণ-র অমূল্য হয়ে যাওয়া নিয়ে। সিনেমার দর্শকের একটা নিজস্ব জগৎ থাকে কি? এমনটাই কি ভাবতেন সত্যজিৎ? হয়ত বিদেশি দর্শকদের কাছে, তাদের মনে বসে যাওয়া একটা ধারণায় দ্বিতীয় কোনো গল্প গজিয়ে ওঠার সম্ভাবনা থেকে সত্যজিৎ রবীন্দ্রনাথের ‘অপূর্বকৃষ্ণ’-কে সত্যজিৎ করলেন ‘অমূল্য’। বিষয়টি নেহাতই অনুমান। তবে পাঠক বিবেচনা করতে পারেন।

আরও পড়ুন
সত্যজিতের লেখা নাটিকা

আরও পড়ুন
নামাঙ্কনের কলমকারি হরফদারি

লক্ষ করবেন, অপু ট্রিলজিতে রয়েছে তিনজন অপু। অপু-ত্রয়ীর শেষ ছবি ‘অপুর সংসার’-এ অপুর স্ত্রী অপর্ণার মৃত্যু ঘটনাও সুবিদিত। তাহলে, ১৯৫৯ সালে তৈরি ‘অপুর সংসার’ ছবিতে বিদেশি দর্শক দেখলেন, অপুর স্ত্রী মারা যাচ্ছেন। এর দুই বছর পরেই আবার এই ‘তিনকন্যা’ ছবির শেষ ছবিতে দেখা গেল, যে চরিত্রটি শহরে পড়াশোনা শেষ করে গ্রামে ফিরছে তার নামও ‘অপূর্বকৃষ্ণ’। তাকে তার মা নিশ্চয়ই ডাকবেন অপু বলে। তার উপরে দুটি চরিত্রেই আবার একই অভিনেতা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাইরের দর্শক যদি ভেবে বসে, যে-অপু নিয়ে এতগুলো ছবি হয়েছে, সেই অপু বুঝি আবার ফিরে এলো--- আবার একটি নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল! সেই সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কথাটা মনে রেখে কি না এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হল সত্যজিৎকে। অন্য কোনো যুক্তিতে নয়, সম্ভবত একেবারেই ওই সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কথাটি মনে রেখেই সত্যজিৎ বদল করলেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের চরিত্রের নাম। তাহলেই তো অমূল্য মায়ের ডাকে হবে অমু। এই নাম-বদলের ব্যাপারটা নিয়ে মনের ভেতরে একটু সংশয় ছিল বলেই বুঝি ‘সমাপ্তি’-র চিত্রনাট্যে বারেবারে ফিরে আসে মানুষের নামের প্রসঙ্গ। অমূল্যর জন্য যে পাত্রী বেছে রেখেছিল, তার নাম ‘পুঁটি’ শুনেই নাক কোঁচকায় শহুরে-বাবু অমূল্য। তার উত্তরে মা ছেলেকে মনে করিয়ে দেন, ‘আর আমার নাম যে খেঁদি’। এমনকি, মৃণ্ময়ী নামটিও অনেক পরে উদ্ধার করা হয়। পাড়ার সকলে যে তাকে কেবল ‘পাগলি’ নামেই ডাকে এবং তার আসল নামটি ভুলে গিয়েছে সেটাও গল্পের চিত্রনাট্যে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা হয়। আবার চরিত্রটির ডাকনাম যে মিনু--- সেটিও উল্লিখিত। তবে তার আসল নাম হল, মৃণ্ময়ী। এইখানেই রবীন্দ্রনাথের চরিত্রের নামকরণের মজা। একেবারে মাটির সঙ্গে বড়ো হয়ে-ওঠা মেয়ে কিনা, তাই তার নামও রবীন্দ্রনাথও দিয়েছিলেন মৃণ্ময়ী। সত্যজিৎ-এর লেখাতেও এই নামের মজা আছে--- সেখানে তার নানান ধরন নিয়ে আড্ডা বসবে আগামী হপ্তায়। 

আরও পড়ুন
শুটিংয়ের বৈঠকি গপ্পো: এক অভিনব গদ্যবিষয়

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর পঞ্চভূত