রবিশঙ্কর: সেই থেকে তৈরি হয়েছিল একটা অ্যান্টি- ফাদার ফিলিং

শঙ্কর সরণি - ২২
আগের পর্বে

উদয়শঙ্করের সঙ্গে পূর্বপরিচয় ছিল অক্ষয় নন্দীর। অমলাও তাঁর নাম শুনেছিলেন। কিন্তু চোখের সামনে উদয়কে দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন অমলা। এরপর একদিন উদয়শঙ্কর তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে গেলেন পিতা-কন্যা। বহুদিন পর বাঙালিয়ানার স্বাদ পেলেন অমলা। উদয়শঙ্করের নাচ তাঁকে আরও মুগ্ধ করল। উদয়শঙ্কর তাঁকে দলে নিলেন। ইউরোপজুড়ে প্রদর্শনীর আগে প্রয়োজন প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা। শঙ্কর-বাড়িতেই থাকতে হল তাঁকে। প্রায় সমবয়সী রবিশঙ্করের সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠল অচিরেই। এদিকে সংসার বিবাগী শ্যামশঙ্কর বহুদিন পর ফিরে এলেন সন্তানদের মাঝে। রোজ সন্ধ্যায় রবিশঙ্করের সঙ্গে অমলাকেও পড়াতে বসাতেন তিনি। এভাবেই অমলা হয়ে উঠলেন পরিবারেরই একজন।

উদয়শঙ্করের প্রতিষ্ঠা আর বিকাশের ইতিবৃত্তে প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে আরো একটি অসামান্য জরুরি আখ্যান। সেই কাহিনিকে জুড়ে না নিলে অসম্পূর্ণ রইবে শঙ্কর-সরণি। আজ কথা তাই, রবিশঙ্করকে নিয়ে। এক কিংবদন্তির উত্থানকালে, খুব স্বাভাবিকভাবেই, তাঁকে ঘিরে গুণিজনের নিত্য সমারোহ। বিশুদ্ধ ঘরানার সংগীত, কারুশিল্প, সাহিত্যের নিরবিচ্ছিন্ন চর্চা। অহরহ, অবিরত এক শৈল্পিক চর্যাবাস। সর্বোপরি সেইসব তেজিয়ান মানুষের সংস্পর্শ, খোদ ইতিহাস যেখানে নতজানু। মানুষের সান্নিধ্য, সে তো শুধু চোখের দেখায় বা নিত্যনৈমিত্তিকতায় নয়, তাঁদের সৃষ্টিলোক আর তাঁদের গুণের পূর্ণরূপটিকে লাভ করা, কী আশ্চর্য সৌভাগ্য। উদয়শঙ্করের জীবনের সহযাত্রী হিসেবে এইসব খাজানার অধিকারী হয়েছিলেন রবিশঙ্কর, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু একথাও স্বীকার করতে হবে যে, তাঁর ছিল তুলনারহিত এক বীক্ষা। এক অনুপম মনের গড়ন। জীবনকে দেখবার, বোঝবার তাঁর ছিল এক্কেবারে নিজস্ব এক পদ্ধতি। প্রাণখোলা অথচ তটস্থ, অনুরক্ত অথচ নিরপেক্ষ। সৎ। সত্যভাষী। খেয়াল করলে দেখব, শঙ্কর-পরিবারে মেধা-প্রতিভার যে বহুশাখায়িত ধারা তাঁর অনুপুঙ্খটিকে লিপিবদ্ধ করেন তিনিই। কথাচ্ছলেই তাঁকে বুনে দেন ইতিহাসের সঙ্গে। সেইসঙ্গে জরুরি এ কথাটাও ভুললে চলবে না যে, পরিবারের মেধা-ঐশ্বর্যের দিকটিকে যেমন তিনি এনেছেন প্রকাশ্যে, তেমনই আড়ালে রখেননি তার অন্তরঙ্গ স্ববিরোধগুলিকেও। তাঁদের জীবনের একান্ত রূঢ় সত্য আর অসহায়তাকেও জানিয়েছেন অবলীলায়। কারণ খণ্ড যে সত্য, তা অসত্যের তুল্য। তিনি দেখতে চেয়েছেন পূর্ণতাকে। লক্ষ করব, যা দেখবার, যা গ্রহণ করবার, তাঁর মন নিঃসংকোচ সংগ্রহ করত তাকে। এমনকি হাজার বিরোধ-বিচ্যুতির মধ্যেও। কারণ জীবন তাঁর কাছে এজলাস নয়, এক প্রবাহ। অনিঃশেষ, অফুরান, বহুকৌণিক, বহুমাত্রিক আনন্দময় এক চলমানতা। স্থবিরত্বের কটাক্ষ তার থই পাবে না। ভারতীয় রীতি-পদ্ধতিতে কখনও-কখনও তিনি ছকভাঙা, খাপছাড়া। চাইলেই নিজের হরেক প্রথাভাঙা আর মিথ ডিঙিয়ে চলাকে তুলে রাখতে পারতেন তোরঙ্গে। করেননি। কেতাবি চালে মহত্ত্বের উত্তরীয়কে করে তোলেননি নিজের সাজ। নিরাভরণ দাঁড়িয়েছেন সময়ের কাছে। কখনও বেদনাবিদ্ধ কখনও নির্মম। অমীমাংসিত অথচ অকপট। যা সত্য তা-ই তো সুন্দর। যা পূর্ণসত্য তা-ই শুচিশুভ্র।

১৯২০-র ৭ এপ্রিল রবিশঙ্করের জন্ম। ভোরবেলায় তাঁর জন্ম, কাশীতে। রবিশঙ্কর যখন গর্ভে, তখনই ঝারোয়ার এস্টেটের কাজ ছেড়ে শ্যামশঙ্কর চলে যান বিলেত। গর্ভবতী হেমাঙ্গিনী তিন সন্তানকে নিয়ে বাস করতে এলেন কাশীতে। তিলোভাণ্ডেশ্বরের গলিতে। ওখানে বিশ্বাস জমিদার ছিলেন শ্যামশঙ্করের বন্ধু। পরিবারকে দেখাশোনার দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে চলে গেলেন শ্যামশঙ্কর। নতুন সন্তান আসছে পরিবারে। কিন্তু অনুপস্থিত গৃহকর্তা। দীর্ঘ-দীর্ঘ দিন। নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে রবিশঙ্কর সবসময়ই বলেছেন, নিঃসঙ্গতা, একপ্রকার একাকিত্বই তাঁর শৈশবের আধার। উদয়শঙ্কর তখন বিলেতে। রাজেন্দ্রশঙ্কর তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড়। দেবেন্দ্রশঙ্কর বারো বছরের। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ভূপেন্দ্রশঙ্কর। মাত্র দশ বছরের বড়। নরম-সরম, ঝাঁকরা চুলের সৌম্যকান্তি এই ভাইটিকে ভারি ভালো লাগত তাঁর। কেউ বকা-ঝকা করলে ছাতে বসে একলা কাঁদতেন ভূপেন্দ্র। টানা টানা দুটো চোখ ভেসে যেত জলে। উপর্যুপরি উৎপাত শুরু করতেন রবি। এরকম করে কাঁদো কেন? তুমি কি মেয়ে? ভূপেন্দ্রর কাঁধে চড়ে দেখতে যেতেন সিনেমা। রবিশঙ্কর তখন আট, প্রথম মৃত্যু দেখলেন। সাজানো রয়েছে ভূপেন্দ্রর মৃতদেহ। অমন সুন্দর চেহারা নিয়ে শুয়ে আছেন কোমল-হৃদয়, প্রিয় মানুষটা। যেন ঘুমোচ্ছেন। এই প্রসন্ন স্তব্ধতা ডুকরে তুলল হতবাক শোককে। কী অবিশ্বাস্য। কী গভীর বিষাদ। তখন তিনি মাত্র আট। তবু এ শোক মায়ের কাছে কতখানি, কী ভীষণ ভয়ঙ্কর। তাঁর শৈশবে এসে ছায়া ফেলল সে কথাটাও।

হাঁ-করে-থাকা সংসারের দায়ভার নিতে হেমাঙ্গিনী অহর্নিশ যুঝতেন নিত্য অনটনের সঙ্গে। আমরা আগে বলেছি সেকথা।  নিজের বহুমূল্য গহনা, দ্রব্যাদি বাধ্যত তিনি বাঁধা দিতেন সহৃদয় প্রতিবেশীর দোকানে। রাতের অন্ধকারে সকলের অগোচরে তিনি বের হতেন পথে। সিল্কের চাদরে আত্মগোপন করে। সে দুর্ভোগের আঁচ পেতে দেননি এমনকি সন্তানদেরও।  রাতের অন্ধকারে স্বামী আর পরিবারের মর্যাদাকে রেখেছিলেন অবিচল। রাতের অন্ধকারে নিজেদের জীবনের নির্মম বেদনা থেকে সন্তানদেরও সাধ্যমতো রাখতে চেয়েছিলেন দূরে। কিন্তু মায়ের এই একান্ত দুঃখ অভিযানের সঙ্গী ছিলেন বালক রবি। এ কাজে কোলের সন্তানটিকে কাছ-ছাড়া করেননি হেমাঙ্গিনী। হয়তো ভেবেছিলেন এ ঘটনা রেখাপাত করবে না অবোধ  শৈশবে। কিন্তু বয়সের যুক্তিসীমা লঙ্ঘন করেও সন্তানের স্মৃতিতে লগ্ন হয়ে থেকেছে মায়ের বেদনা। রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ‘জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই’ এ ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তিনি। নিজের কনিষ্ঠ সন্তানটি ছিল হেমাঙ্গিনীর দুঃখসহচরী।

বালক রবিশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাইনে তোমারে

ছোটো ছিলেন বলে মায়ের আশপাশটাই ছিল তাঁর জগৎ। সেইসময় নিবিড়ভাবে তিনি দেখেছিলেন হেমাঙ্গিনীর সংগ্রাম আর তাঁর অপ্রতিরোধ্য বাৎসল্য, দুটিকেই। স্মৃতিচারণায় মূর্ত করেছিলেন বয়ে যাওয়া সেই অতীতকে। রান্নায় হেমাঙ্গিনীর হাত ছিল অতুলনীয়। সামান্য তরি-তরকারিতেও হাতে স্বাদ খুলত অপূর্ব হয়ে। আতিশয্য ছিল না। তবু মশলা-ফোড়নের রদবদলে, ঢিমে আঁচে কষে-নেড়ে নেওয়ায়, সুঘ্রাণ ছড়িয়ে থাকত তাঁর পাকশাল জুড়ে। ছেলেদের সঙ্গে পাত পড়ত, রাজেন্দ্র-দেবেন্দ্রর স্বজন-বন্ধুদেরও। গার্হস্থ্যের সংসারে অতিথি দেবতা। হেমাঙ্গিনীর কাছে তাঁদেরও ছিল আব্দার আর আদরের ফরমাস। খেতে বসে যেন আশ মিটত না তাঁদের। ওই অতটুকু আয়োজনে এমন তৃপ্তি করে খেত তাঁরা। চোখ জুড়িয়ে যেত হেমাঙ্গিনীর। সেই সমস্ত কিছু সামলে উঠে নিজেরটুকু কুলিয়ে উঠত না আর। সকলের অলক্ষ্যে একটুকরো গুড় ফেলে দিতেন মুখে। তারপর নিজের পেতলের ঘটি থেকে ঢকঢক করে খেয়ে নিতেন জল। তিনি মনে করতেন বটে, সকলের আড়ালে এই নিতান্ত আত্মবঞ্চনাটুকু সেরে ফেলে নিস্তার পেলেন। কিন্তু মায়ের এই লুকিয়ে রাখা আত্মত্যাগটুকু নজর এড়াত না তাঁর সর্বকনিষ্ঠ পুত্রটির।

শিশু রবিশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
ঈশ্বর তোমাকে নৃত্যের জন্যই গড়েছেন

 দিনের পর দিন নিজের পরে এই অবহেলা ছাপ ফেলেছিল তাঁর চেহারাতেও। লম্বা-চওড়া গড়নে তা ঠাহর হত না খুব। ব্যথার মধ্যে দিয়ে দেখতেন যিনি, তাঁর চোখে ধরা পড়ত এক অবক্ষয়। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনুভূতিটি জানিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। বলেছিলেন, ‘আমার মায়ের গড়ন, মানে হাড় খুব চওড়া ছিল। এটা উনি আমার দাদামশায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। দাদামশায় প্রায় ছ’ফুট লম্বা ছিলেন, পালোয়ান গোছের। মায়ের bone structure এমন ছিল যে, কেউ বুঝতে পারত না। আমি কিন্তু শুধু কয়েকটা হাড়ই দেখতে পেতাম। উনি এত কষ্টে নিজেকে রাখতেন। আমি খুব feel করতাম, আমার ভীষণ কষ্ট হত। সেই থেকে আমার মধ্যে একটা anti-father feeling এসে গিয়েছিল।’


আরও পড়ুন
নৃত্য সেদিন পেরিয়ে গেল মঞ্চের সীমা

পড়াশোনা ছাড়াও রাজেন্দ্রশঙ্কর খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। চ্যাম্পিয়ন ছিলেন ব্যাডমিন্টনে। কাশীরই একটা সংগীত সমিতিতে ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন। হারমোনিয়ম, সেতার, এস্রাজ, বাঁশি এসবের ওপরেও ছিল অল্পবিস্তর দখল।  তাঁদের বাড়ির একটি ঘরে, যত্ন করে রাখা থাকত এই সমস্ত যন্ত্র। ছোট্টো রবিশঙ্কর ঘুরে বেড়াতেন তার মধ্যে। কখনও-সখনও টুংটাং উঠলে অন্যপ্রান্ত থেকে ধেয়ে আসত সতর্কবার্তা। দাদারা কলেজ চলে গেলে, মা নিমজ্জিত সংসারে, একলা বাড়িতে তার সঙ্গী ছিল বই। পাঁচ বছরে হয়েছিল হাতেখড়ি। কিন্তু নিজের সঙ্গে সময় কাটাতে-কাটাতে তার আগেই কেমন করে যেন শুরু হয়ে গিয়েছিল পড়া। ঠাকুরমার ঝুলি, দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, রবার্ট ব্লেক। 

কিশোর রবিশঙ্কর

 

আরও পড়ুন
উদয় প্যারিসে ফিরছেন তাঁর নিজের তৈরি দল নিয়ে

যেকোনো বিষয়ে তাঁর ছিল দেখবার চোখ। তাঁর বর্ণনায় কী সুন্দর হয়েই না ধরা দেয় সেসময়ের কাশী। তিলোভাণ্ডেশ্বরের গলি থেকে বাসা বদলে তাঁরা এলেন তিন নম্বর বাড়িতে। সে বাড়ির বারান্দা পড়ত রাস্তার মুখে। তিলোভাণ্ডশ্বরের মন্দিরের পুরোহিতরা সমস্ত অন্তর্জগৎ নাড়া দিয়ে ধুন তুলতেন ‘হর হর মহাদেও’। বিশ্বনাথের মন্দির থেকে পুরোহিতরা মন্ত্রগানে উজাড় হয়ে সেই পথে হেঁটে যেতেন সারি সারি। কল্পনা ছবিটিতে ঠিক এমনই আশ্চর্য, অপার্থিব একটি দৃশ্যকে গড়েছিলেন উদয়শঙ্কর। কাশীর বারোয়ারি দুর্গাপুজোরও ছিল আরেক অভূতপূর্ব ধারা। ভোর চারটের সময় উঠে সবাই শ্রেণিবদ্ধভাবে হেঁটে যেত দুর্গাবাড়ির দিকে। বালক রবিশঙ্কর জেদ ধরতেন। তিনিও যাবেন দাদাদের সঙ্গে। অতখানি পথ। দাদারা অনুৎসাহিত করতেন, তারপর হতোদ্যম হয়ে ছেড়ে দিতেন হাল। পথ দেখতে-দেখতে ক্লান্ত রবিশঙ্কর ঘুমিয়ে পড়তেন দাদাদের কোলে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতেই জাগাতে হত না কাউকে। অথচ সেই ছোট্টোবেলার স্মৃতিটুকুতে ঐতিহ্য, বাহার আর ইতিহাসকে কী সংবেদী মন নিয়ে ধরে রেখেছিলেন তিনি। দেশের সব প্রান্তের মানুষ মিশে হাঁটছে পথ। কেউ গাইছে কীর্তন, কেউ ভজন। তীব্র, দার্ঢ্য উচ্চারণে ভেসে চলেছে সংস্কৃত শ্লোক। ভাসছে সদ্য ফোটা জুঁই-চামেলির সুবাস। তার সঙ্গে ওম হয়ে আছে ধূপ আর ধুনো। তারই মধ্যে ধীরে ধীরে রাতপ্রহর সরিয়ে ফুটছে আলো। সেই আলোয় অতীব ধীরে ফুটে উঠছে মন্দির।  সংগীত, মন্ত্র, সুগন্ধ, নিসর্গ কী আদিম পূজা উপচারে সেজে উঠত মহামানবের তীর্থলোক।

রবিশঙ্করের অজস্র স্মৃতিকে,  কথাকে সময় থাকতেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। ‘রাগ-অনুরাগ’ আর ‘স্মৃতি’ এই বই দুটির জন্য বাঙালি চির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে থাকবে তাঁর কাছে। কাশী নিয়ে বলবেন অথচ কাশীর ঘাটের কথা উঠবে না, এমনটা তো হতে পারে না। বিচিত্রপুরী সেই ঘাটকে কী সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন রবিশঙ্কর তাঁর ‘স্মৃতি’ বইতে। বলেছিলেন, ‘কাশীর ঘাট—it was always charming এখনও it charms me। ওই একটা ঘাটে, দশাশ্বমেধ ঘাটে—you see the whole life like a panorama from birth to death, from the sublime to the ridiculous। এই কথাটা আমি কাশী সম্বন্ধে বলতে ভালোবাসি। একাধারে যেমন চাঁই চাঁই পণ্ডিত ছিলেন, বড়ো বড়ো মনীষী, বড়ো বড়ো intellectual মহামহোপাধ্যায়, তর্ক চূড়ামণি— একগাদা। এছাড়া বড়ো বড়ো ধ্রুপদীয়া রাজত্ব করছেন। আবার অন্যদিকে কী সব গুন্ডামি, লোচ্চামি, বিধবাদের কেচ্ছা। এই কাশীতেই তৈলঙ্গস্বামী, ভাস্করানন্দ, বিশুদ্ধানন্দ হয়ে গেছেন। আবার ওই ঘাটে বসেই কত সাধু সন্ন্যাসী ভড়ং দেখিয়েও গেছে। এই যে extreme এটা কাশীর মতো আর কোথাও দেখিনি। হিন্দিতে একটা কথা আছে—রাঁড়, ষাঁড়, সিঁড়ি, সন্ন্যাসী/ চারো সে বাঁচে তো সেবে কাশী।’ এই উদ্ধৃতিতে ধরা পড়বে, খণ্ড সময়ের ভেতরেও তিনি কীভাবে দেখতে জানতেন সমগ্রকে। তাঁর দেখায় আংশিক নির্বাচন প্রাধান্য পেত না। গুরুত্ব পেত বিবিধ বিরোধ আর বৈচিত্র্যের মধ্যেও যে পারস্পরিক সহাবস্থান আর সুষমা, সেইটি। ঘাটের অনুষঙ্গে তাই বৈদগ্ধ্য আর আধ্যাত্মিকতা এবং ভন্ডামি আর কেচ্ছাকাহিনির উদ্ভটত্ব এসেছে একই পংক্তিতে। অসুন্দরের সংস্পর্শেও নির্বিঘ্নে তিনি দেখতে জানতেন পবিত্রকে। 

Powered by Froala Editor