‘দৈনিক বসুমতী’ হয়ে আরও...

মুছে যায়? - ২৭
আগের পর্বে

ষাটের দশকে বেলুড় আর বালির মাঝামাঝি তৈরি হয় একটি জাহাজবাড়ি। সেখানে বড়দিন, ফার্স্ট জানুয়ারিতে নামে মানুষের ঢল। পাশেই বালি সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সাঁতারকেন্দ্র। সেখানে সাঁতার কাটতেন কমরেড সরোজ বসু ওরফে পুলু। সেসময় বালিতে খেলাধুলোর চর্চা হয় খুব। বালিতে আয়োজিত একাধিক টুর্নামেন্টে খেলতে আসত বাইরের ফুটবল দল। আবার বালির খেলোয়াড়রাও ময়দানে খেলতেন দুই প্রধান ক্লাবে। ইংরাজি নববর্ষে ভিড়ে ভিড় বেলুড়, দক্ষিণেশ্বরও। দক্ষিণেশ্বরে সেদিন ‘কল্পতরু’ উৎসব। দৈনিক বসুমতীর সংবাদদাতা থাকার সময় ভিক্টোরিয়া, আলিপুর চিড়িয়াখানার পাশাপাশি খবর করতে হত দক্ষিণেশ্বরের ভিড় নিয়েও। তারপর...

দৈনিক বসুমতীর অ্যাকাউন্টস আর ক্যাশ ডিপার্টমেন্টে ছিলেন শচীনবাবু, বিষ্টুবাবু, বিলাসবাবু। শচীনবাবু সব সময় ভাউচার আটকাতে চাইতেন। অ্যাকাউন্টসের বিষ্ণুবাবু— বিষ্টুবাবু, বিলাস ভাউচার পেমেন্টে উদার, বিশেষ করে বিষ্টুবাবু। বিষ্টুবাবু সব সময় আমার ভাউচার পেমেন্ট দ্রুত করাতেন। বিষ্টুবাবুর পরনে হাতা গোটান ফুল শার্ট, ধুতি। কোঁচকান কোঁচকান চুল টেনে খুব তেল দিয়ে আঁচড়ান। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। বিলাসবাবু হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি, ধুতি, ঘন ঘন নস্যি। গলায় কেমন যেন একটা প্রভুত্বের ভাব থাকে সব সময়।

শচীনবাবু ধুতি, শার্ট। ধুতি-পাঞ্জাবি। বিবাহের পর তিনি প্যান্ট-শার্ট ধরলেন। তুলনা হয় না, তবু যেমন কিনা গণেশ পাইন। কলেজ স্ট্রিট মার্কেটে ‘বসন্ত কেবিন’-এর আড্ডায় তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি, শীতে শাল। তখন তিনি নর্থের। উত্তর কলকাতার ঐতিহ্য ও কেতা তাঁর চলনে, বলনে, পোশাকে।

‘দৈনিক বসুমতী’র সম্পাদক হেমেন্দ্রকুমার ঘোষ নাকি নিজের নাম বলার সময় বলতেন, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘষ। এই তথ্যটি আমায় দিয়েছেন কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ খুব নাম করা সাংবাদিক ও সম্পাদক। আজকাল আর কেউই প্রায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, চপলাকান্ত ভট্টচার্য, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারদের নাম করেন না। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ নাকি কলকাতার এক পরম বৈষ্ণব সাংবাদিক ও সম্পাদককে ব্ল্যাকমেল করার জন্য তাঁদের গরুর মাংস বিক্রির কাজ করার কাগজপত্র নিজেদের কাছে রেখেছিলেন। সেই কাগজ থাকার ফলে নিয়মিত মাস গেলে টাকা পেতেন তিনি সেই ‘পরম বৈষ্ণব’ সাংবাদিক সম্পাদকের কাছ থেকে।

হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের মৃত্যুর পর সেই কাগজের জন্যে নাকি তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করা হয় তাঁর ঘর-বাড়ি। সেই গোপন-রোজগারের কাগজটির জন্য। সেই ‘গুপ্ত’ কাগজটি শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছিল কিনা জানা যায়নি।

আরও পড়ুন
সাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণ! ৯০ বছর আগে যে বাঙালির স্পর্ধায় অবাক হয়েছিল দুনিয়া

সম্পাদক, সাংবাদিক, লেখক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের থুতনিতে জমান, প্রায় পাকা ফ্রেঞ্চকাট, মাথার চুল বেশ ছোট করেই ছাটা, অন্তত দৈনিক বসুমতীর ক্যাশ ঘরে— ক্যাশ কাউন্টারের দেওয়ালে তিনি সেভাবেই বিরাজমান ছিলেন ১৯৭৮-৭৯-৮০ সালে। পাশেই শ্রীরামকৃষ্ণ। হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের এই তেল ছবিটি খুব বড় নয়। বরং কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসার বাঁকের মুখে দেওয়ালে বড় করে উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। বসে আছেন। ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে জুতো, এই অয়েল পেইনটিংটি বেশ বড়সড়।

১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর বড়সড় ছাদ। ছাদে দাঁড়ালে নিচে কলকলায়মান বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট, কাছেই বৌবাজার, কোলে মার্কেট, হাড়কাটা গলি, লাট্টু পাড়া। একটি বড়সড় গাছ ফুটপাতের ওপর। তার গায়ে লা পাড়, কোরা কাপড় জড়ান। সেখানে ‘ভর’ হয় এক মহিলার, প্রতি শনি-মঙ্গলবার। সম্ভবত শীতলার ‘ভর’। এই ভর বা ট্রেন্সের সময় তিনি অনেক অনেক বিলকি-ছিলকি-ভবিষ্যৎবাণী করেন। তাঁকে ঘিরে ধূপ জ্বলে, ধুনো পোড়ে। প্রচুর ভক্ত সমাগম। চুল খুলে যায় ‘ভর’-এর সময়। দীর্ঘ, কুঞ্চিত কেশমালা।

দীর্যাঙ্গী তিনি নন মোটেই, বরং তাঁকে খর্বকায়াই তো বলা ঠিক হবে। ধর্মের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে জোরে জোরে ঢাকও বাজে। ফুটপাথ ভরে থাকে লোকজনে। বৌবাজার মোড় থেকে ১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট আসতে গেলে বড় রাস্তা, ‘ব্যাঙ্ক অফ ইনডিয়া’র বাড়ি পেরিয়ে খানিকটা এগোলেই বাঁদিকে সেই ভর-বৃক্ষ। ফুটপাতের ওপর ভাজা চানা-ছোলা, খোলা ছাড়ান মুঙফালি। সঙ্গে ফ্রি ঝালনুন। তারপর রেডিমেড রুটি তৈরির দোকান, রোল, চাউমিন।

বসুমতীর গাড়ির দেখভাল করতেন মহাদেববাবু। তাঁর মোটাসোটা চেহারা। কালো চুল— ঘন, ব্যাকব্রাশ, উলটে আঁচড়ান। ভারী গাল, ক্লিন শেভেন। তাঁর বিবাহিত স্ত্রী বহু বছর হল অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে ঘর ছেড়েছেন। মহাদেবের একটিই সন্তান— পুত্র, নাম ‘বাবু’। বাবু বছরের মধ্যে ন’ মাস বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, বেশিরভাগটাই বম্বের পথে। বম্বে তখনই মুম্বাই হয়নি। রেস্টুরেন্ট, চায়ের দোকান, ধাবা, সর্বত্র তার ‘চাগরি’— চাকরি। 

আরও পড়ুন
আমাদের বড়দিন, সাহেবি নববর্ষ— নিঃসীম

মহাদেব ‘বাংলা’ খান। তাঁর পদবী সম্ভবত দাস। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আর যখনই আমি বসুমতী অফিসে ঢুকি না কেন, সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের সঙ্গে বা একা, তিনি আমাকে দাঁড়িয়ে উঠে স্যালুট দিতেন। কেন এই স্যালুট— সেলাম, অভিবাদন, বুঝতাম না। আজও বুঝি না।

কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ধার-বাকি ইত্যাদিতে অভ্যস্ত। ফলে অনেকের কাছেই তিনি অনায়াসে হাত পাততেন, তোর কাছে ‘টু হবে’, মানে দুটো টাকা হবে কিনা, জানতে চেয়ে। তবে ধারের টাকা তিনি গুনে গুনে ফেরত দিতেন। কোনো দিন তাতে এ ব্যতিক্রম হতে দেখিনি।

‘দৈনিক বসুমতী’-র সাংবাদিকদের স্যালারি হত ইংরেজি মাসের পয়লা। ক্যাশে। তখন বাঘমার্কা লালচে নোট, ২ টাকার। এক টাকাও কড়কড়ে। পাঁচ টাকা তো আছেই। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় এক তারিখ মাইনে পেয়েই কাগজে কলমে লেখা ধারের হিসেব চুকোতে বসতেন। ক্যান্টিনের বিল— চা-খাবার, বেয়ারাদের থেকে নেওয়া ধার, সব পর পর, শোধ করতেন। আবার ইংরেজি মাসের ২ তারিখ থেকে ধারের শুরু।

কল্যাণদা তাঁর পাতায়, ‘দৈনিক বসুমতী’-র ‘রবিবাসরীয়’তে লিখতেন, তাঁদের কারও কারও কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন। ঐ দুই, পাঁচ, দশ বড়জোর। আবার শোধও দিতেন কড়ায়গণ্ডায়। বদ্রিনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলে একজন লেখক লিখতেন কল্যাণদার সময়ে, সাময়িকীতে। বদ্রিদা টাক মাথা, সব সময়ই একটু যেন অস্থির, বড় চাকরি করতেন। সম্ভবত দক্ষিণ কলকাতার যদুবাবুর বাজারের কাছে লক্ষীবাবুর সোনাচাঁদির যে সারবাঁধা দোকান, তাঁরই কাছাকাছি কোনো বাড়িতে থাকতেন। ওঁদের পৈতৃক সম্পত্তি। ওখানকার বহু পুরনো লোক ওঁরা। বদ্রিদার তখন বিচ্ছেদের মামলা চলছে স্ত্রীর সঙ্গে। বদ্রিদা তাঁর দুঃখের কথা বলতেন প্রায়ই। এছাড়াও ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবারের পাতায় লেখেন কুন্তল মুখোপাধ্যায়, ডানকুনির দীপংকর চক্রবর্তী, অতনু বসু, শুভ্রা ভট্টাচার্য, চপলা বর্মণ, শ্যামলী আচার্য, কণা সেন, এরকম অনেকে।

আরও পড়ুন
ছোটোবেলার ‘ব-ব-জামা’— বড়দিন

বসুমতী-র সাব এডিটিং টেবলের তাপস, রণেন, শিখর, ত্রিদিব, পথিক গুহ, জগদীশবাবু, শশাঙ্ক সরকার, নির্মল গঙ্গোপাধ্যায়— সবাই লিখতেন। লিখতেন শেলিবাবু।

তাপস দাস, রণেন মুখোপাধ্যায়, শিখর মজুমদার, ত্রিদিব চক্রবর্তী, পথিক গুহ ছাড়াও বসুমতীর সাবিং টেবলে ছিলেন অঞ্জলি মজুমদার, মৌ মুখোপাধ্যায়। অঞ্জলি শিখর মজুমদারের স্ত্রী, মৌ ফটোগ্রাফার সুদর্শন মুখোপাধ্যায়ের সহজীবনের মানুষ। ‘দৈনিক বসুমতী’-র স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন দীপালি কুমার ঘোষ। ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই তিনি ‘জয় তারা’, ‘জয় জয় তারা’ বলে প্রবল চিৎকার করতেন। প্রায়ই তারাপীঠ যেতেন তিনি। খানিকটা মদ-আসক্ত, তাঁর ‘তারা মায়ের’ ভক্ত দীপালিদার সঙ্গে তাপসদাও ছিলেন। সেই সঙ্গে উজ্জ্বল বসু। তিনি রেসের মাঠের খবর করতেন। কলকাতার রেসের ঘোড়াদের সম্ভাব্য জেতা বা হারা নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। সঙ্গে ব্যাঙ্গালোর রেস। ‘উইনে’, ‘ট্রিপল টোটে’ এইসব শব্দভাণ্ডার তাঁর থেকে শিখি। তখন কলকাতা রেসকোর্সের পাশাপাশি টালিগঞ্জের রেসও আছে। কলকাতার রেসের মাঠে এক সময় নিয়মিত যেতেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস। 

সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে রেসের মাঠ, ঘোড়দৌড় আছে। বরুণ চন্দ তাঁর সিনেমার শ্যালিকা শর্মিলা ঠাকুরকে নিয়ে গেছেন রেসের মাঠে। বরুণ চন্দের তখন মাথাভর্তি ঘন ঢেউদার, কালো চুল। ক্লিন শেভেন, পরনে স্ট্রাইপদার কোট, প্যান্ট। হাতে বাইনোকুলার, ঘোড়দৌড় দেখার জন্য। দৃশ্যিটি— সেই শট মনে গেঁথে আছে। দৈনিক বসুমতীর সাব এডিটর তাপস দাসের দাদা ছিলেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র কোর্ট রিপোর্টার— আদালতের সংবাদদাতা। য্যগান্তর-এর কানাই দত্ত দক্ষিণ শহরতলি ইত্যাদিক্র সঙ্গে কোর্টও সামলাতেন। কানাই দত্ত ধুতি, টেরিকটের রঙিন পাঞ্জাবি, শীতে শাল, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, মাথায় কলপদার চুল। যদিও বেশ পাতলা হয়ে এসেছে। পায়ে ব্যাকবেল্ট। খুব শৌখিন মানুষ। তিনি ‘যুগান্তর’-এর হয়ে গঙ্গাসাগর কভার করেন বহু বছর, বলতে গেলে তিনি একেবারে গঙ্গাসাগরবিদ।গঙ্গাসাগরে কিছু হলেই কানাই দত্ত। নিঃসন্তান কানাইদার মামা ছিলেন প্রভাস রায়। তিনি ছিলেন কাকদ্বীপ আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ।

গজেন মালী, অহল্যা মা, প্রভাস রায়, কংসারী হালদার, হেমন্ত ঘোষাল, প্রকাশ রায়— যাঁকে নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী ‘স্বদেশের ধূলি’ নামের আখ্যান নির্মাণ করেছিলেন, প্রকাশ রায় তাঁর ছদ্মনাম, না ভাঙা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি— সি পি আই প্রকাশ রায়কে ‘ট্রটস্কি পন্থী’ বলে চিহ্নিত করে ও দল থেকে বহিষ্কার করে। উৎপল দত্ত, ঋত্বিককুমার ঘটকও ‘ট্রটস্কিবাদী’, তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ‘বিতর্কিত দলিলে’। ‘ট্রটস্কিবাদী’র সঙ্গে ‘টিটোবাদী’ বিশেষণও।

আরও পড়ুন
ব ব ব বড়োদিন — হাঃ – হাঃ – হা

যাক সে সব কথা।

‘দৈনিক বসুমতী’তে ১৯৭৭ সালের পর চারের পাতায় পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতেন কল্পতরু সেনগুপ্ত, নির্মল গাঙ্গুলি, ধীরেন ভৌমিক। নির্মল গাঙ্গুলি ও ধীরেন ভৌমিক সুভাষপন্থী ফরোয়ার্ড ব্লক-এর সমর্থক। তাঁরা হেমন্ত বসু, নলিনী গুহদের ফরোয়ার্ড ব্লক-এর বিরোধী। সুভাষচন্দ্রের আত্মীয় সুব্রত বসু ছিলেন এই রাজনৈতিক দলে। ধীরেন ভৌমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। তিনি অত্যন্ত স্টাউট চেহারার, কলপদার চুল, মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, খাদির ধুতি।

সুভাষপন্থী ফরোয়ার্ড ব্লকের সর্বভারতীয় নেতা ছিলেন শীলভদ্র যাজী। এই ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রভাব খুব বেশি ছিল না। ফরোয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটি ছিল তখন। এখনও আছে সম্ভবত।

মূল ফরোয়ার্ড ব্লক থেকে ভেঙে বেরিয়ে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরি করেন রাম চট্টোপাধ্যায়, সুহৃদ চৌধুরীরা। রাম চট্টোপাধ্যায় বা রাম চাটুজ্জে ছিলেন হুগলীর তারকেশ্বর থেকে নির্বাচিত বিধায়ক— এম এল এ।

রাম চাটুজ্জেকে খুব পছন্দ করতেন জ্যোতি বসু। প্রমোদ দাশগুপ্ত রামবাবুকে পছন্দ করতেননা একেবারেই। এসবই আমার শোনা ও জানা কথা।

জ্যোতিবাবুর প্রশ্রয়ে রাম চট্টোপাধ্যায় যুক্তফ্রন্ট এবং বামফ্রন্টের মন্ত্রী ছিলেন। দমকল মন্ত্রী হয়েছিলেন মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রতীম চট্টোপাধ্যায়, অনেক পরে। তিনি সিনেমা, সিরিয়ালও করতেন। তিনি লাইসেন্সড রিভলভার সহ ঘুরতেন। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল জুয়েলারির।

শুনেছি রামবাবুর ধানুকীরা ছিলেন, যাঁরা তীর-ধনুক চালানতে ওসাদ। তিনি বড়সড় ওজনদার কালো ‘রয়্যাল এনফিল্ড’ অথবা ‘বুলেট’ চেপে যত্রতত্র ঘুরতেন। অত্যন্ত ভালো জ্ঞান তাঁর অস্ত্র বিষয়ে। রামবাবু শুনেছি যখন কলকাতায় আসতেন, তখন তাঁর গাড়িতে বিভিন্ন লোকজন তুলতে তুলতে যেতেন। একদম টই-টম্বুর গাড়ি।

শুনেছি প্রতি নির্বাচনের আগে তিনি নাকি তারকেশ্বরে বাবা তারকনাথের মন্দিরের সামনে একটি আকন্দের মালা নিয়ে খালি গায়ে দাঁড়াতেন। দুধ পুকুরে তিনি নাকি স্নান করে এসেছেন তার আগে। পরনে হেটো ধুতি।

তারকেশ্বর মন্দির থেকে কেউ বেরিয়ে এলে রামবাবু নাকি বলতেন, ভাই ব্রাহ্মণের ছেলে দাঁড়িয়ে আছি ‘বাবা’-র মন্দিরে পুজো দিয়ে। আমি বলছি ভাই, আপনারা— আপনি আমায় ভোট দেবেন তো?

কে আর না বলবেন, বারণ করবেন রামবাবুর কথায়! নিষেধ করবেন। তাঁরা সম্মতি দিলেই রামবাবু বলতেন বামুনের ছেলে ভাই, আমার পৈতে ছুঁয়ে বলুন। তারকেশ্বর মন্দির ফেরত— তারকনাথের দর্শন করা কেউ একজন তখন প্রায় বাধ্য হয়েই প্রতিজ্ঞা করেন তিনি মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক প্রার্থী রামবাবুকে— রাম চ্যাটার্জিকে ভোট দেবেন।

ব্যস, হয়ে গেল। একটি, দুটি, তিনটি— এভাবেই ভোট নিশ্চিত। এই গল্পের সত্যতা কদ্দুর, আমার জানা নেই। 

দক্ষিণ কলকাতার লেক স্টেডিয়ামে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রকাশ্য অধিবেশন। ‘দৈনিক বসুমতী’-র দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা হিসাবে খবর করার জন্য আমি উপস্থিত।

মঞ্চে রাম চ্যাটার্জি তো আছেনই, সেই সঙ্গে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী। আর আছেন জ্যোতি বসু। তখন তিনি বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। রাম চ্যাটার্জি টেরিকটের সাফারি স্যুট, স্যুটের ওপরের যে অংশ, তা হাফ হাতা। দীর্ঘকায় রাম চ্যাটার্জি যিনি বাঙালি বা ভারতীয়রা ঢুকতে পারবে না, এমন নিষেধাজ্ঞা সরন্বিত জলে লাফ দিয়ে নামে। খালি গায়ে সাঁতার কাটেন? সেটা কি ‘অ্যান্ডারসন ক্লাব’? মনে নেই আজ আর স্পষ্ট। কিন্তু তাঁর এই জলে লাফিয়ে পড়া বাংলা খবরের কাগজে তিনের পাতায় ছবি ও খবর হয়ে এল। 

আমার স্মৃতিতে আছে ১৯৬৮ সালটাল হবে ঘোর শীতে বালিতে ধোপা পাড়ার কাছাকাছি যে দুটি ক্লাব-মাঠ, তারই একটাতে কোনো একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান, সেই ক্লাব-মাঠ দুটির নাম যথাক্রমে ‘তরুণ সংঘ’ ও ‘নবীন সংঘ’। বালি স্টেশনে রাস্তার গা লাগোয়া প্রায় ‘তরুণ সংঘ’ তারপরই ‘নবীন সংঘ’।

বালি স্টেশনে যাওয়ার বড় রাস্তা আর ‘তরুণ সংঘ’-র মাঠের মধ্যে একটা কাঁচা খানা— নর্দমা। বর্ষায় টইটম্বুর। মশার আঁতুড়ঘর, সারা বছর। বালি গ্রাম— পুরনো মানুষেরা এইভাবেই সম্বোধন করতেন বালিকে। বালিগ্রাম। বালিগ্রাম।

কথায় কথায় বলা হত—
‘ছিরে বিরে শান্তিরাম
এই তিনে বালিগ্রাম।’

বলা হত—
‘কাগজ কলম বালি
এই তিনে বালি।’

সেই সঙ্গে পার্শ্ববর্তী সালকে বা সালকিয়া সম্বন্ধে ছিকুলি কেটে বলা হত—
‘গাঁজা গুলি কলকে
এই তিনে সালকে’

আবার উত্তর পাড়া বিষয়ে প্রচলিত ছিকুলি—
‘গাড়ি বাড়ি ফুলের তোড়া
এই নিয়ে ওতোরপাড়া’

তো সে যাই হোক, ছিরে, বিরে এবং শান্তিরাম— তিনজনেই কৃতী পুরুষ। শান্তিরামের নামে বালি ‘শান্তিরাম বিদ্যালয়’। যার নাম আগে ছিল ‘টমসন স্কুল’। বালিতে বিদ্যালয় বলতে ‘বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়’, ‘বালি বঙ্গশিশু বালিকা বিদ্যালয়’, ‘বালি শিক্ষানিকেতন’, বালি মেকলে স্কুল। ‘মেকলে’ ও ‘বঙ্গশিশু বালিকা বিদ্যালয়’ গার্লস স্কুল। বাকি সব বয়েজ এবং কো এড। শিক্ষানিকেতন ছিল কো এড।

‘বালি শান্তিরাম বিদ্যালয়’, ‘বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়’, ‘বালি বঙ্গশিশু বালিকা বিদ্যালয়’ খুবই পুরনো স্কুল। তুলনায় ‘বালি শিক্ষানিকেতন’ নবীন।

এবার পুনরায় রাম চাটুজ্জে বা রাম চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে ফিরি। তাঁর নামের সঙ্গে কখনও অসামরিক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, কখনও ক্রীড়ামন্ত্রকের ভার, এসব জড়িয়ে গেছে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার সময়।

বালির ‘তরুণ সংঘ’ অথবা ‘নবীন সংঘ’-র কোনো একটা বাৎসরিক ফুটবল টুর্নামেন্ট, নয় স্পোর্টস ইত্যাদির পুরস্কার বিতরণী সভায় রামবাবু এলেন কালো মোটরবাইকে চেপে সম্ভবত ‘রয়্যাল এনফিল্ড’ অথবা ‘বুলেট’। তখন অবশ্য বাজারে ‘রাজদূত’ মোটর সাইকলেও এসে গেছে। স্কুটার বলতে ‘ভেসপা’ আর ‘লুয়ামব্রেটা’। দুটোই ইতালিয়াঙ্কোম্পানি। ‘ভেসপা’ আয়তনে খানিক ছোট, ‘ল্যামব্রেটা’ বড়। তার স্পেস অনেকখানি। ‘ভেসপা’ই বেশি চলে, ‘ল্যামব্রেটা’ কম। পরে ‘ভেসপা’ স্কুটার বাজাজ হয়ে যায়।

স্ততর দশকে দিল্লি, ইলাহাবাদে প্রচুর ‘ল্যামব্রেটা’, ‘ভেসপা’ও। দিল্লিতে প্রথম দেখি মহিলারা বিশেষ করে পাঞ্জাব তনয়ারা, ‘ভেসপা’ চালাচ্ছেন। ‘ভেসপা’, ‘ল্যামব্রেটা’কে ফটফটিয়া বলাহত ইলাহাবাদে।

রাম চ্যাটার্জি এলেন বড়সড়, হেভি, ব্ল্যাক মোটরবাইকে। পরনে টেরিকটের প্যান্ট। ওপরে ভারী, কালো জ্যাকেট। পায়ে ফিতে বাঁধা কালো শ্যু। তিনি এক লাগ দিয়ে ‘তরুণ সংঘ’ মাঠেরসামনে যে জল ভরা, প্রায় টইটম্বুর খানাটি তা পেরলেন। তাঁর সিকিউরিটি গার্ড কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো লাফ দিয়েছেন মন্ত্রীমশাই। কালো, হট্টাকট্টা, ব্যায়াম করা চেহারা। নাকের নিচে গোঁফ।

বড় রাস্তা থেকে লাফ দিয়ে ‘তরুণ সংঘ’-র শিশির বিজড়িত হয়ে থাকে ভোর ভোর, এমন শষ্পুকুরের ওপর এসে পড়লেন মন্ত্রীমশাই, এসেই সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন, এতটাই বডি ফিট, দেখে বিস্মিত হতে হয়।

প্রথমে সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, পরবর্তী সময়ে রাম চ্যাটার্জির মৃত্যু মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক নামের দলটিকে প্রায় ‘অনাথ’ করে দেয়। রামবাবুর স্ত্রী শান্তি চ্যাটার্জি, যতদূর মনে পড়ে এই নামটাই ঠিকই লিখলাম, তারকেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন ও জিততেন, সেও তো রাম চ্যাটার্জির নামেই। প্রয়াত রাম চ্যাটার্জি’র বিধবা পত্নী হিসাবে।

প্রয়াত রামবাবুর সেন্টিমেন্ট তাঁকে এই নির্বাচনী যুদ্ধে অনেকটাই এগিয়ে রাখত মূল প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। রামবাবুর ছিল এক রবিন হুড ইমেজ, তাঁর ছিল ধনুর্ধর বাহিনী, সেকথা আগেই লিখেছি।

১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৬৯-এর পয়লা মে মনুমেন্ট ময়দানে সি পি আই (এম-এল)-এর প্রথম প্রকাশ্য সভা, ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বামফ্রন্টের সভা— সব মিলিয়ে প্রবল সংঘর্ষ, সেই পলিটিক্যাল ক্ল্যাশে রাম চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল সংঘর্ষ নায়কের। সঙ্গে তাঁর বাহিনী। নকশালপন্থীদের ওপর আক্রমণ চালায় এই বাহিনী। পাল্টা মারও দেন নকশালপন্থীরা, বোমা, পুলিশের কাঁদানে গ্যাস— সব মিলিয়ে ব্যাপক সংঘর্ষ ক্ষেত্র।

রাম চ্যাটার্জির বাহিনীর হাতে তখন বেশ কয়েকটি জিপ। হুডখোলা, মারমুখী। সেই জিপের ব্যবহার বিভিন্ন অ্যাকশনে হত।

মরিচঝাঁপি কাণ্ডেও রাম চ্যাটার্জি ও তাঁর বাহিনীর ভূমিকা ছিল যথেষ্ট। তা নিয়ে খানিক লেখালিখিও হয়েছে তখন। 

হেমন্ত বসু, নলিনী গুহ, অশোক ঘোষ, কমল গুহ, সুব্রত বসুদের ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’-এর সঙ্গে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক-এর যে দূরত্ব, তা তাত্ত্বিকভাবে যত না, তার চেয়ে বেশি হয়ত ব্যক্তি কেন্দ্রিক।

ফরোয়ার্ড ব্লক-এর দলীয় পতাকায় লাল জমির ওপর উল্লফন— লাফ দেওয়া বাঘ, তার সঙ্গে কাস্তে-হাতুড়ি— সম্ভবত এই কাস্তে-হাতুড়িকেই শীলভদ্র যাজীরা মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা নিজেদের সুভাষবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক বলতেন।

মার্ক্সবাদী ফড়োয়ার্ড ব্লক-এ সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, রাম চ্যাটার্জি এছাড়াও অমরেন্দ্রবাবু বলে একজন সংগঠক ছিলেন। তাঁর পদবি এখনই মনে পড়ছে না।

লেক স্টেডিয়ামের যেখানে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক-এর প্রকাশ্য সমাবেশ, সেখানেই পণ্ডিত রাধিকা মোহন মৈত্রর সরোদবাদন, সঙ্গে পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও মন্টু ব্যানার্জির অসামান্য হারমোনিয়াম-বাদন শুনেছি। সে এক শীতের সন্ধ্যা। পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র এলেন বাজাতে। খুব চমৎকার মুখশ্রী। পরিপাটী সাজগোজ, সিল্কের পাঞ্জাবি, পা সরু পায়জামা, পায়ে জুতো— নাগরা স্টাইল। তাঁর হাতে হিরের দামি আংটি, সোনার। নাকের ইচে বাহারি সরু গোঁফ, চোখে সোনালি ফ্রেমের বাহারদার চশমা। মাথার চুল উল্টে আঁচড়ান। তেমন লম্বা নন মোটেই। এমনিতেই আমি পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র ও পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যের বাজনা খুব পছন্দ করি। পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার, পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্রর সরোদ মুগ্ধ করেছে বারে বারে।

পণ্ডিত জ্ঞানবাবু— জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের সঙ্গে, পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী আমার অত্যন্ত প্রিয় শিল্পী। পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী ও পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার দাদামশাই হরিপদ রায়ের বেশ ভালো জানাশোনা ছিল। হরিপদ রায় নিজে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রচুর চর্চা করতেন। ক্লাসিক্যাল— ধ্রুপদী সঙ্গীতকে তিনি বলতেন ‘ওস্তাদি গান’। পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁদের জানাশোনার কথা দাদামশাইয়ের মুখেই শুনি।

হরিপদ রায় আমার রাগ দুর্গা, সরস্বতী, কালেংড়া, মালকোষ, ছায়ানট, ভৈরবী, দরবারিকানাড়া,  জয়জয়ন্তী ইত্যাদি প্রভৃতি নানা সময় নিজের গায়িকি দিয়ে বুঝিয়েছেন। তাঁর গলা যে খুব সুরে বাঁধা ছিল এমন তো নয়, বিশেষ করে বয়সকালে। কিন্তু তাঁর রাগ ও রাগিণী বিষয়ে জ্ঞান ছিল যথেষ্ট। ছয় রাগ, ছত্রিশ রাগিণী বিষয়ে তিনি নানা কথা বলতেন। অনেক পরে স্বামী প্রজ্ঞানানন্দর ‘রাগ রূপ’ অনেক পড়ে পাঠ করি। অসামান্য সেই গ্রন্থ, তা বার বার পড়তে হয়। জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী— জ্ঞান গোঁসাইয়ের চমৎকার গায়কি, উচ্চারণ, তারাপদ চক্রবর্তীর গলাও চমৎকার। এখন ইউটিউবে পাওয়া যায়, দুজনের গানই।

জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁর কণ্ঠবাহার হারমোনিয়াম বাদন শোনার, অনেকক্ষণ ধরে শোনার। মন্টু ব্যানার্জির হারমোনিয়ামও দুর্দান্ত। অসাধারণ হারমোনিয়াম বাজাতেন ভীষ্মদেব চটতোপাধ্যায়, তাঁর গলায় জয়জয়ন্তী আধারিত ‘ফুলের দিন হল যে অবসান’, অথবা ‘তব লাগি ব্যথা ওঠে গো কুসুমি’, ‘যদি মনে পড়ে সে দিনের কথা/ আমারে ভুলিও প্রিয়’ কিংবা ‘অলক লগন...। হায়, হায়, হায়! কি অসাধারণ গলা এবং গায়কি! শুনতে হয় কান, মন, প্রাণ ভরে। বার বার। বার বার শুনতে ইচ্ছে জাগে।

কিংবদন্তি গায়ক ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় প্রখ্যাত আখ্যানকার নরেন্দনাথ মিত্রর স্ত্রীকে গান শেখাতেন, তাঁর পাইকপাড়া অঞ্চলের বাড়িতে গিয়ে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তখন চাকরি করেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। গল্প, উপন্যাস লিখে, বিশেষ করে ছোট গল্প লিখে তাঁর তখন যথেষ্ট নাম হয়েছে। সামান্য তোতলা, একটু লাজুকও হয়ত, মুখচোরা নরেন্দ্রনাথ মিত্র পুজোর সময় বহু কাগজে লিখতেন। তখন আনন্দবাজার বাড়ির— ‘বড়বাড়ি’র তার লেখকদের ওপর রোকটাক— রোখটোখ বা ‘এখানে লিখতে পারবে না’, ওখানে লিখতে পারবেনা, এই বেড়া চালু হয়নি।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র ও নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে নাকি একটা চাপা প্রতিযোগিতা তাই থাকত, কে কোন কাগজে, কত বেশি লিখতে পারেন। এসবই শোনা কথা। এও শুনেছি কলেজস্ট্রিট মোড়ে নাকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ মিত্রর দেখা।

মানিকবাবু ‘পরিচয়’ অফিস থেকে বেরিয়েছেন। শেয়ালদা যাবেন, ‘বাংলা’-র খোঁজে। তাঁর নেশার রসদ, সস্তা কান্ট্রিলিকার।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে এগিয়ে এলেন গুটিশুটি পায়ে, একটু লাজুক লাজুক মুখে। তাঁর হাতে নিজের একটি বই। তিনি মানিকবাবুকে গ্রন্থটি দিতে চান সমালোচনার জন্য। সম্ভবত ‘পরিচয়’ অথবা ‘নতুন সাহিত্য’ পত্রিকায়।

যিনি আমায় এ কাহিনী বলেছেন, তিনিও পঞ্চাশ দশকের বেশ নামটাম করা কথাকার। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী নরেন্দ্রনাথ মিত্র, একটু ময়লার দিকে রঙ, মাথার চুল ব্যাকব্রাশ, খানিকটা শাই— লাজুক। তাঁর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মানিকবাবুও ধুতি-পাঞ্জাবি। তাঁর গাত্রবর্ণও প্রায় কৃষ্ণবর্ণ। চোখে চশমা। তখনকার  বেশিরভাগ হিন্দু বাঙালি লেখকই ধুতি-পাঞ্জাবি। কাজী নজরুল ইসলাম তোও নিয়মিত ধুতি-পাঞ্জাবি ।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র সামান্য তুতলে যেতেন কখনও কথা বলতে গেলে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের বইটি দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি, আধফোটা স্বরে— লাজুক উচ্চারণে বলতে চাইছেন, নিজের গ্রন্থটির সমালোচনা যদি মানিকবাবু লিখে দেন আর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সামনে একটি চলমান ট্রাম দেখেতে পেয়ে প্রায় লাফ দিয়ে সেই ট্রামের পাদানিতে উঠে বললেন, এ বয়সে আর শত্রুতা বাড়াতে পারব না।

সেই নরেন্দ্রনাথ মিত্রর স্ত্রীকে রাগসঙ্গীত শেখাতেন সাধকপ্রায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। তিনি পাইকপাড়ায় নরেন্দ্রনাথ মিত্রর বাড়ি গিয়ে গান শেখাতেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রর স্ত্রীর নাম কি নমিতা, নাকি সবিতা? অথবা এর বাইরে কিছু? তিনি লিখেছিলেন ‘কলেজস্ট্রিট’ পত্রিকায় ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ওঁকে গান শেখানে এসে প্রথমেই একটি পাট করা, কাচা ধুরি পরতেন, লুঙ্গি স্টাইলে। বাইরের জামা কাপড়-ধুতি-পাঞ্জাবি ছেড়ে খালি গায়ে বসতেন সাধারণত। তারপর রেওয়াজ, গান। —‘ফুলের দিন হল যে অবসান।’

ভীষ্মদেবকে পেয়েছি তাঁর শেষ বয়সে। দেখা করেছি। তখন তিনি পণ্ডিচেরী ফেরত অন্য মানুষ।

দক্ষিণ কলকাতার লেক স্টেডিয়ামে রাধিকামোহন মৈত্রর সরোদ, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও মন্টু ব্যানার্জির হারমোনিয়াম, মার্ক্সবাদী ফরোয়ারদ ব্লকের প্রকাশ্য সমাবেশ, সবই পরপর সামনে চলে আসে, এক এক করে।

আগামী পর্বের ‘মুছে যায়?’-তে সেই মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক-এর প্রকাশ্য সভায় রাম চ্যাটার্জির বক্তব্য পেশ করা, তারপর তা নিয়ে জ্যোতি বসুর প্রতিক্রিয়া— সবটা— সবটা বলার ইচ্ছে রইল। বলার ইচ্ছে রইল তিন বিঘায় গুলি চলা এবং সেখানে আমার ‘দৈনিক বসুমতী’র সাংবাদিক হিসাবে চলে যাওয়া ও রিপোর্ট করার কথা।

স্টেটসম্যানের কোর্ট রিপোর্ট করতেন যিনি, তাঁকে আমরা মুখার্জিদা বলেই জানতাম। এক মাথা পাকা চুল, কদম ছাঁট। বারো মাস টেরিকটের সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট। শীতের দিনে নীল ব্লেজার, পায়ে ‘বাটা’ কোম্পানির সাদা কেডস। মুখার্জিদা গম্ভীর। তাঁর পেছনে খুব লাগতেন ‘যুগান্তর’-এর কানাই দত্ত। আনন্দবাজারের কোর্ট রিপোর্ট করতেন ‘দৈনিক বসুমতী’র সাব এডিটর তাপস দাসের দাদা। তাঁর নাম সম্ভবত তরুণ দাস। তিনি গম্ভীর, মাথায় চুল পাতলা হয়ে এসেছে। প্যান্ট-শার্ট। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র যিনি আদালত সংবাদদাতা, কোর্ট রিপোর্ট করতেন, তাঁর মুখে শ্বেতী, পারতপক্ষে কথা বলতেন না কারও সঙ্গে। তাঁর টেরিকটের ফুলশার্ট, ফুলপ্যান্ট পরা চেহারাটি চোখে সামনে ভাসে। সামনে সামান্য ঝুঁকে হাঁটতেন। ঘন ঘন সিগারেট। তাঁর হাতেও শ্বেতীর দাগ।

Powered by Froala Editor