সেলুলার জেলে শেষের সুদিন

‘কালাপানি’ আন্দামান— ৪৫
আগের পর্বে

১৯৩৩-৩৬ সাল পর্যন্ত আগের তুলনায় খানিক স্বাধীনতা পান রাজবন্দিরা। কিন্তু তারপরেই ফের বদলে যায় পরিস্থিতি। উত্তরপ্রদেশ থেকে বদলি হয়ে সেলুলার জেলে আসেন সুপারিটেন্ডেন্ট রোসেয়ার। ক্ষমতায় এসেই রাজবন্দিদের অধিকার খর্ব করেন তিনি। অন্যদিকে আন্দামান পরিদর্শনে এসে, হেনরি ক্রুক জানালেন রাজবন্দিরা স্বর্গরাজ্যে আছে। সরকারের মন রেখে রিপোর্ট দিলেন আরও দুই ভারতীয় সাংসদও। রাজবন্দিরা জেলে দাবিসনদ পেশ করলেও লাভ হল না কোনো। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭ সালের ২৩ জুলাই পুনরায় হরতালের পথ বেছে নিলেন রাজবন্দিরা। ২৯০ জন বন্দিদের মধ্যে প্রায় ২৩০ জনই অংশ নিয়েছিলেন এই হরতালে। তবে এবার আর সেলুলার জেল প্রশাসন জোরাজুরি কিংবা শাস্তিপ্রদানের দিকে গেল না। বরং, রাজবন্দিদের বন্দি রাখল তাঁদের কারাগারেই। তারপর…

প্রথম ধর্মঘট ও ভুখা হরতালের পরে রাজবন্দিরা যে অধিকার আদায় করতে পেরেছিলেন তার ফলে তাঁরা পেলেন অনেকানেক সুবিধা, পেলেন এক আনন্দময় জীবনের সন্ধান; কারাজীবনে এই প্রথমবার তাঁরা স্বাধীনতা পেলেন। এর আগে সেলুলার জেলে ও দেশের কারাগারে বারেবারে যে অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তার থেকেও মুক্তি পাওয়া গেল। ‘সি’ শ্রেণির রাজবন্দিরাও পেলেন খাট, বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের ওয়ার, মশারি, গায়ে মাখার সাবান এবং তোয়ালে। পরনের হাফপ্যান্ট এবং গেঞ্জি তাঁরা এখন নিজেদের টাকায় কিনতে পারেন। সবজি, চাল এবং আটার মান উন্নত হল। বিভিন্ন ধরনের ডাল, আলু এবং পেঁয়াজ খাদ্যতালিকায় যুক্ত হল। একদিন ছাড়া ছাড়া পাতে মাছ এল। রান্নাঘরের দায়িত্বও ছাড়া হল রাজবন্দিদের  হাতে।

১৯৩৩-৩৭ – এই চার বছরে যে সমস্ত বাঙালি রাজবন্দি সেলুলার জেলে দেশ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে এসেছিলেন তাঁদের বেশিরভাগই তরুণ। এখানে আসার আগে আনেকেই ছিলেন স্কুল, কলেজের ছাত্র। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের মতো তখন তাঁরা লঘু-আনন্দময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করার জন্য বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে তাঁদের জীবন উৎসর্গীকৃ্ত ছিল। ক্লাসের অন্যান্যরা যখন ভাবনাচিন্তাহীন জীবন কাটাচ্ছে তখন তাঁরা জীবনমরণের সরু সুতোর ওপর দিয়ে হাঁটছেন। তাঁদের স্বপ্ন দেশকে স্বাধীন করা। তাঁরা বন্দুক ছোঁড়া অনুশীলন করছেন, বোমা বাঁধছেন কিন্তু অনেকেরই সঙ্গীত, ফুল, চিত্রকলার প্রতি ভালোলাগা-ভালোবাসা আছে।

আন্দামানে এসে হরতাল করে তার ফলশ্রুতি হিসাবে এবার এক সুস্থির জীবন পাওয়া গেল। এইসময়ে কাজের  মারাত্মক কোনো চাপ ছিল না আর নিজেদের মধ্যে মেলামেশায় তেমন বাধাও ছিল না। দিনেরবেলায় সেলের বাইরে করিডোরে নিজেদের মধ্যে তাঁরা আড্ডা মারছেন, কেউ নানা ধরনের জোকস বলছেন, অন্যরা হেসে গড়িয়ে পড়ছেন।  রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে কোনো সেল থেকে ভেসে আসছে উদাত্ত কণ্ঠের গান। সত্যি কথা বলতে কী, এর আগের জীবনে আনন্দ-ফুর্তির কোনো স্বাদ পাওয়া যায়নি। প্রথম অনশন ধর্মঘট (মে, ১৯৩৩) রাজবন্দিদের সামনে যে সমস্ত সুবিধা এনে দিয়েছে, তার পুরো লাভ ওঠাতে এখন সবাই ব্যস্ত। খেলাধুলা, সঙ্গীতচর্চা, নাটক, চিত্রাঙ্কন, শরীচর্চা – সবকিছুরই পুর্ণ সদ্ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে নোংরা ফাটল ধরা সেলে বাস, ভগ্ন স্বাস্থ্য, নিম্নমানের খাদ্য; কিন্তু সবকিছুরই সান্ত্বনা ছিল বিভিন্ন ধরনের বিনোদন। এসব ছাড়া সেখানে পড়াশুনা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক কিছুই সাফল্য পেত না।  

জুলাই মাসে হরতাল শেষ হবার পর প্রথম যে আনন্দদায়ক সুবিধা রাজবন্দিরা পেয়েছিলেন তা হল সেলুলার জেলের ভেতরে দুর্গাপূজার আয়োজন করা। পুজো উপলক্ষে বিভিন্ন কমিটি স্থাপন করা হল। জেলের ভেতরেই এক রাজবন্দি বানিয়ে ফেললেন প্রতিমা। এরপর জেলের থালা-বাটি, ঢোল বাজিয়ে, বয়সে যাঁরা তরুণ তাঁদের উৎফুল্ল কণ্ঠে চিৎকারের মধ্য দিয়ে বোধন হল প্রতিমার। নাচ-গান-নাটকে কেটে গেল পুজোর পাঁচদিন।

আরও পড়ুন
আবারও দুর্দশা, আবারও হরতাল

এরপর শুরু হল পড়াশুনা। অনেকেই যাঁরা মাঝপথে স্কুল-কলেজ ছেড়ে এসেছিলেন, তাঁদের পাঠদানে রত হলেন শিক্ষিত সহযোদ্ধারা, এর পাশাপাশি শুরু হল মার্কসবাদ চর্চা। সারাদিন ছয়ঘণ্টায় চারটি পিরিয়ড ক্লাস করতে হত। শুরু হল দেয়াল পত্রিকা বের করা। প্রায় ডজনখানেক পত্রিকা প্রকাশ পেতে শুরু করল, যার মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল ‘The Call’.

আরও পড়ুন
সঞ্চারিত চেতনা এবং ঐক্য – মার্কসবাদ চর্চা কেন্দ্র

খেলাধুলা ছিল সবথেকে বেশি বিনোদনের উপকরণ। সারাদিন পড়াশুনা করে বিকেলে সবাই ছুটতেন খেলার মাঠে। ফুটবল ছিল সবার প্রিয় খেলা। জেলের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে ছিল ফুটবলা খেলার মাঠ, খুবই ছোটো, খুব বেশি  হলে একটা টেনিস কোর্টের থেকে সামান্য বড়ো। তাছাড়া মাঠটি ছিল অসমান এবং পাথুরে। কিন্তু এসব কোনো বাধাই নয়। তবে এই মাঠে এগারোজনের দল খেলানো সম্ভব নয় দেখে সাতজনের দু’টি দল তৈরি করে খেলা হত। এর থেকেও বড়ো যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তা হল কীভাবে প্রায় শ’দুয়েক ফুটবল-প্রেমীকে খেলায় সুযোগ দেওয়া যায়। এই সমস্যার কিছুটা সমাধান করা হল আধঘণ্টা করে দিনে তিনটি ম্যাচ খেলা, যার ফলে পঞ্চাশজন সুযোগ পেতেন। বাকিরা হতাশ হয়ে অন্য খেলায় অংশ নিতেন। কিন্তু অন্য খেলা বলতে আর ব্যবস্থা ছিল শুধু ভলিবল খেলার, সেখানে জনা চল্লিশেকের সংস্থান হত। আর বাকিরা? বেশ কিছুজন নিজেদের মধ্য দল গড়ে ‘কাবাডি’, ‘দাড়িয়া-বান্ধা’ খেলতেন। তবু অনেকেই পড়ে থাকতেন, যাঁদের আর কোনো খেলাধুলার সুযোগ থাকত না। তাঁরা এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতেন, নিজেদের মধ্যে গল্প-গাছা করতেন, নয়তো খেলার দর্শক হয়ে কোনো একটা টিমকে সমর্থন করে হৈচৈ করতেন।

আরও পড়ুন
ক্রান্তিকাল

ফুটবল খেলার মাঠ ছোটো হওয়ার কারণে খুব দ্রুতগতিতে খেলা হত। পাথুরে জমি, একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়ার ফলে অনেকেরই মাথা ফাটত, হাত-পা ভাঙত। তা সত্ত্বেও খেলোয়াড়দের উৎসাহে ভাটা পড়ত না। একজন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবী ছিলেন দুর্দান্ত হাফ-ব্যাক। আন্দামানে জল-হাওয়ায় তাঁর শরীর ভগ্নপ্রায় হলেও তাঁর খেলা ছিল প্রশংসনীয়। তবে তিনি খেলতে নামার আগে কোনো উদ্দীপক নেশার দ্রব্য নিতেন এবং অনেকদিনই খেলা শেষের আগে  মাঠে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেন, তখন তাঁকে ধরাধরি করে মাঠ থেকে তুলে আনা হত। ফুটবল টুর্নামেন্টের সময়ে ‘স্পোর্টস কমিটি’ দেয়াল পত্রিকা বের করত। তাদের নিজস্ব সম্পাদক, রিপোর্টার এবং কার্টুনিস্ট ছিল। সেখানে আগের দিনের খেলার খবর ছাড়াও কোনো এক বেচারা খেলোয়াড়কে নিয়ে কার্টুন বেরোত। সবারই নজর থাকত কে সেই খেলোয়াড়, যিনি সেদিন কার্টুনিস্টের শিকার হবেন। মাঝেমাঝেই ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলা হত নক-আউট বা লিগ প্রথায়। সেখানে বিজয়ী দলের জন্য শিল্ড দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এই শিল্ডগুলি নিজেরাই জেলের ভেতরে তৈরি করতেন। এমনই একটা শিল্ডের নাম ছিল – ‘Hunger Strike Memorial Shield’. নিজেদের মধ্যে দল গঠন করা হত। যাঁরা যাবজ্জীবনের জন্য এসেছিলেন তাঁদের ছিল নিজেদের ‘Lifers’ Association’. তাঁরা আলাদা দল গঠন করে টুর্নামেন্টে খেলতে নামতেন। তাঁদের সঙ্গে যখন লড়াই হত নন-লাইফারদের, তখন মাঠের বাইরে যাঁরা যাবজ্জীবনের জন্য এখানে আসেননি, সংখ্যাধিক্য হবার কারণে তাঁদের গলার জোর বেশি হত। খেলায় অবশ্য দেখা যেত যে সেই খেলা দু-তিনদিন ধরে চলছে এবং সবসময় খেলা ড্র হচ্ছে – কোনো মীমাংসাই হচ্ছে না। 

আরও পড়ুন
ভুখা হরতাল – মহাবীর সিং, মোহন কিশোর নমোদাস ও মোহিত মোহন মৈত্র

ইনডোর গেমস বলতে ব্যবস্থা ছিল তাস, দাবা, ক্যারাম ও টেবিল টেনিস খেলার। তবে রবিবার বা বৃষ্টির দিন, যখন বাইরের খেলা সম্ভব নয়, তখনই এই খেলাগুলোর সদ্ব্যবহার হত। বৃষ্টি পরপর টানা চলতে থাকলে স্পোর্টস কমিটি ইনডোর গেমস কম্পিটিশনের ব্যবস্থাও করত।

রাজবন্দিদের অনেকেই শরীরচর্চা করতেন। সরকারি খরচায় একটি প্যারালেল বার ও একটি হরাইজন্টাল বারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর নিজেরা চাঁদা তুলে আরও কিছু শরীরচর্চার জিনিসপত্র কেনা হয়েছিল। এখানে অনেকেই ছিলেন ভালো বক্সার এবং কুস্তিগীর। মাঝেমাঝেই তাঁদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হত। অনেকেরই তা নিয়ে উৎসাহের অন্ত ছিল না।  কোনো কোনো বিশেষ দিনে ব্যবস্থা করা হত শারীরিক ক্ষমতা প্রদর্শনের। সেদিন জেলের অফিসাররা তাদের গাড়ি নিয়ে  আসতেন জেলের ভেতরে। চলন্ত মোটর গাড়ি থামানো, লোহার চেন ছেঁড়া, বুকের ওপরে মালবোঝাই ঠেলাগাড়ি তোলা, একজনের বুকের ওপর ভারী পাথর রেখে অন্যজনের সেই পাথর ভাঙা এবং বারের ওপর খেলা দেখানো হত এই সব বিশেষ দিনে। দু-তিনবার জেলের ভেতরে কাঠ দিয়ে বানানো ড্যাগারের খেলা ও জুজুৎসুর প্যাঁচ দেখানো হয়েছিল।

বার্ষিক স্পোর্টসেরও আয়োজন করা হত। এই স্পোর্টসে ট্রফি জেতার জন্য অনেকেই মাসাধিককাল ধরে অনুশীলন করতেন। এই ট্রফিগুলো নিজেদের চাঁদা থেকে কেনা হত। বার্ষিক স্পোর্টসের দিন সারা জেলখানা ভেঙে পড়ত এক নম্বর ওয়ার্ডের সামনের মাঠে। সবথেকে মজা হত কানামাছি খেলায়। সবার চোখ বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হত ওই ছোটো মাঠটিতে। এই খেলায় মাঠের তুলনায় প্রতিযোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হবার কারণে সে এক মহা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হত। নিজেদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কিতে কেউ কেউ মাটিতে পড়ে যেতেন, কেউ বা ফিনিশিং পয়েন্টর দিকে না গিয়ে দর্শকদের দিকে চলে যেতেন। সে এক মহা মজাদার ব্যাপার! পোল-জাম্প এবং দড়ি টানাটানি ছিল আরেক উদ্দীপক খেলা। আরেক মজাদার খেলা ছিল বস্তা দৌড়। অনেকসময় কোনো মোটা সহবন্দিকে বস্তায় ঢুকিয়ে দেওয়া হত। একবার একজন বস্তাসহ মাঠেই পড়ে গিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যেতে লাগলেন ফিনিশিং লাইনের দিকে। অন্যেরা পৌঁছে গেলেন, কিন্তু তাঁর আর পৌঁছানো হল না। সে এক হাস্যকর দৃশ্য!

প্রায় প্রতিদিন সকাল বেলায় ৫০-৬০ জন হাতে নকল রাইফেল নিয়ে জেলের মাঠে সামরিক ড্রিল করতেন। তাঁদের নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম ও ব্যাজ ছিল। তাঁদের মার্চ পাস্ট অনেকেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে উপভোগ করতেন। পরে অবশ্য তাঁদের কাছ থেকে নকল রাইফেল কেড়ে নিয়ে তার পরিবর্তে বাঁশের লাঠি দেওয়া হয়েছিল।

রান্নাঘর ছিল আরেকটি অতিরিক্ত বিনোদনের জায়গা। অনশন ধর্মঘটের পরে কিছুদিনের জন্য ডিভিশন-২ ও ৩-এর দুটি  রান্নাঘর একত্র করে (পরে নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণে আবার রান্নাঘর দুটি আলাদা হয়ে যায়) রন্ধনকর্মে যাঁরা ওস্তাদ তাঁরা রান্নার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। ওই সামান্য রেশন দিয়ে তাঁরা ভেল্কি দেখালেন।

শুরু হল বিশেষ বিশেষ দিবস পালন – রুশ বিপ্লবের দিবসপালন ছিল সবথেকে মর্যাদাজনক দিন। সেদিন বিশেষ আলোচনা সভা, মিছিল বের করা এবং ফিস্ট করা হত। এর পাশাপাশি পালিত হত মে দিবস, স্পেন ডে, এবং অ্যান্টি-কন্সটিটিউশন ডে। তবে এসবই হত জেল কর্তৃপক্ষকে লুকিয়ে।

একদিন তাঁরা কংগ্রেসের নকল অধিবেশনের ব্যবস্থা করেন। সেখানে জওহরলাল নেহেরু, আব্দুল গফফর খান, সত্যমূর্তি এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতার ভূমিকায় রাজবন্দিরা ছিলেন। এই নকল অধিবেশনে শ্রমিক, কৃষক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতা – বিভিন্ন ভূমিকায় অনেকে অবতীর্ণ হন। সেখানে পণ্ডিত জওহরলাল অধিবেশন উদ্বোধন করতে গিয়ে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে আবেদন রাখেন। জওহরলালকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় এবং তাঁকে কটূক্তি ও লাঞ্ছনা সহ্য করতে  হয়। শুরু হয় অধিবেশনে হৈচৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি; সবাই তখন ‘শান্তি, শান্তি’ বলে ওঠেন। একটু-আধটু হাতাহাতিও হয়। পক্ষে এবং বিপক্ষে স্লোগানও ওঠে। এই নকল অধিবেশনের আয়োজন করে রাজবন্দিদের নিজস্ব ‘ডিবেটিং বোর্ড’।

রবিবার ছিল ছুটির দিন। ছুটি বলতে পড়াশুনা, ক্লাস থেকে ছুটি। সেদিন যে যার নিজের মতো সময় কাটাবে। সেদিন চারদিকে গান-বাজনার আসর বসত, কেউ বা সেদিন চুটিয়ে খেলাধুলা করত। বাজনা বলতে ছিল চার-পাঁচ রকমের তারবাদ্য। যাঁরা সেগুলো বাজাতে পারতেন সেগুলো নিয়ে বোদ্ধা শ্রোতাদের তাঁরা তা এককভাবে বাজিয়ে শোনাতেন। কোনো কোনো রবিবারে আয়োজন করা হত ক্যারিকেচার ও ম্যাজিক শোয়ের। এইভাবে বিভিন্ন ধরনের বিনোদনের আসরে আবিষ্কৃত হত নানা ধরনের প্রতিভা। 

কিন্তু এই সময়ের জেলজীবন কি সত্যিই খুব সুখের ছিল? এত পড়াশুনা, বিনোদনের মাঝে অনেক সময় ফাটল ধরাত কিছু ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করার ইচ্ছা। নিজেদের মধ্যে গ্রুপবাজি, জেল-রাজনীতি, অন্যের বিরুদ্ধে চক্রান্ত, কুৎসা, কাদা ছোঁড়াছুড়ি করা, অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করা – এসব ঝামেল মাঝেমাঝেই লেগে থাকত। প্রথমাবস্থায় এগুলি খুব স্বাভাবিক ছিল কারণ এই সময় অনেকেই আদর্শগতভাবে বদলে যাচ্ছিলেন। মার্কসবাদী বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত হবার কারণে আগে তাঁরা যে গ্রুপের সদস্য ছিলেন তাঁদের অনেকের সঙ্গে, যাঁরা এই দলে ভেড়েননি, বিরোধ বাঁধছে। শুধুমাত্র প্রথমাবস্থাতেই নয় অনেকসময় আন্দামান থেকে বিদায় নেবার আগে পর্যন্ত কারও কারও মধ্যে সম্পর্ক বিষাক্তই রয়ে গেছে। এর জন্য অনেকসময় মন ভেঙে পড়লেও তার সান্ত্বনা হিসাবে ছিল বৈজ্ঞানিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা। বিভিন্ন পর্যালোচনার মাধ্যমে তখন বোঝা যেত এই সমস্ত সম্পর্কের ভাঙনের জন্য কোন ভাইরাস দায়ী। এসবের ফলে মন ক্রমশ যুক্তিবাদী ও দৃঢ় হয়ে উঠত।

তবে নিজেদের মধ্যে যতই বিরোধ থাকুক না কেন, জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধ বাঁধলে সেই সময়ে কিন্তু সবার মধ্যে দৃঢ় ঐক্য দেখা যেত। আবার যখন অসুস্থতার কারণে কাউকে আন্দামান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হত, তখনও সবাই জড়ো হয়ে, তাঁর সুস্থতা কামনা করে বিদায় দিতেন। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম যোদ্ধা, ফণী নন্দীকে যখন অসুস্থতার কারণে বন্ধুদের কাছ থেকে সরিয়ে কলকাতায় আলিপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হল সেদিন কারোরই চোখের জল বাঁধ মানেনি। আর সেটাই ছিল সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ফণীর শেষ দেখা। কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে তাঁর।

ইতিমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। ২৪ জুলাই, ১৯৩৭-এর শুরু হল মরণপণ অনশন ধর্মঘট যার ফল পাওয়া গেল অচিরেই।

Powered by Froala Editor