বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি

মুকুজ্জের দপ্তর – ৫

আগের পর্বে

উদ্ভট রসের গল্প উপন্যাসের জন্য আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। প্রথম উপন্যাস ‘কঙ্কাবতী’ জুড়ে সেখানে প্রেতেদের তামাশা। রহস্য এবং ছমছমে পরিবেশের সমাবস্থান তাঁর লেখায় সহজলভ্য। অন্যদিকে ভূতের গল্প বলতে আবশ্যিক উপেন্দ্রকিশোরের নাম। হাসি, সারল্য, স্নিগ্ধতার ছোঁয়ায় মায়াময় করে তুলেছেন তিনি অশরীরীদের। গুপি-বাঘার কথাই মনে করা যাক। ভৌতিক গল্পেও যে এমন সহজ হাওয়া-বাতাস খেলতে পারে তা উপেন্দ্রনাথ না থাকলে ভাবতে পারা বেশ কঠিনই হত।

‘দার্জিলিং জমজমাট’ উপন্যাসের একটি সিচুয়েশন মনে করুন। এক ও অদ্বিতীয় জটায়ু একদা পাড়ার নাটকে সেজেছিলেন ‘নদু মল্লিক’, (নাটক হয়েছিল পরশুরামের ‘ভূশণ্ডির মাঠ’ গল্প অবলম্বনে)।  বোম্বাইয়ের হিট ছবি-করিয়ে পুলক ঘোষাল, যিনি ‘লালুদা’র পড়শি ছিলেন আগে,  তথ্যটি ফাঁস করে দেন। ফেলুদা পর্যন্ত শুনে থ, এত বড় একটা আইকনিক চরিত্রে আপনি..., এতদিন চেপে রেখেছিলেন? বাংলা সাহিত্যে যে-নদু মল্লিকের তুলনা নেই... শুনে জটায়ুর ছাতি হয়ে যায় প্রখর রুদ্রের ছাতি, অতঃপর নিজেরই গুণপনা নিয়ে তিনি গদগদ হয়ে ওঠেন।

‘নদু মল্লিক’ নিয়ে উচ্ছ্বাস ফেলুদা দেখালেও আমরা বেশ বুঝতে পারছি তা আসলে সত্যজিৎ রায়েরই জবানি। শুধু ‘ভূশণ্ডির মাঠ’ লিখেই রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০) অমর হয়ে যেতে পারতেন। ...গল্পের চরিত্রেরা যদিও ‘ভূত’, তাদের দাম্পত্য সমস্যা একেবারেই ‘মানুষী’।  ইহলোক ও পরলোক – দু’টি জগতই এখানে সঙ্গত করেছে এবং লেখক নামিয়ে এনেছেন এক অপরূপ কার্নিভাল, যার মঞ্চ হচ্ছে প্রেত-বহুল ভূশণ্ডির মাঠ। বাংলা স্যাটায়ার গল্পের তুঙ্গ অর্জন।

‘মহেশের মহাযাত্রা’ – পরশুরামের আরেক সিগনেচার গল্প। অঙ্কের প্রফেসর মহেশ মিত্তিরকে কড়া নাস্তিক হিসেবে দেখিয়ে ইনটেলেকচুয়াল রগড় আরম্ভ হয়েছে। গল্প যত এগিয়েছে, তত মিইয়ে এসেছে কমিক সুরটি – গল্পের কাঁধে চেপে বসেছে জগদ্দল আতঙ্ক। ক্লাইম্যাক্সে এসে সেই আতঙ্ক মুখ ফাঁক ক’রে (ও ধারালো দাঁতগুলি দেখিয়ে) হেসে উঠেছে। পাঠক এখানে বুদ্ধু বনে যায়, গল্পের প্রথমার্ধে যে মানসিক বোঝাপড়া তার থাকে, লহমায় মুচড়ে দেওয়া হয় সেটি। সহজ রাস্তা চতুর মুখোশ খুলে নেয় ও অগম্য অন্ধকার জেগে ওঠে। 

রাজশেখর বসু

 

আরও পড়ুন
‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর

হাসির গল্পকে আশাতীত ভয়ের ক’রে তোলা- এইভাবে ‘জঁর’-এর ‘শিফট’ শিবরাম চক্রবর্তীর কিছু লেখায় পাই। ননসেন্স ছড়ার প্রয়োগ (হরিনাথ ওরে/ পোড়াব না তোকে/ নিয়ে যাব ধাপা... ইত্যাদি) এতটাই দক্ষ, আমাদের মনে পড়ে সুকুমার রায়কে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১)-এর ‘ভূত পতরীর দেশ’ গল্পে ভূত, ভূতুড়েপনা কিংবা অলৌকিক সবই আছে তবু ভৌতিক আখ্যান বলে এটি চালানো বেআইনি হবে। যে বাস্তবটি সূক্ষ্ম কারুকাজ দিয়ে ‘ভূত পতরী...’তে বুনে তোলা হয়েছে, তার সঙ্গে মেলে বরং ‘রূপকথা’র আদল। ঘোড়া ভূতের নিঃশ্বাসে আগুনে-হল্কা কিংবা চারজন প্রেত পালকি-বেহারা (কিচকিন্দে, কাসুন্দে, ঝালুন্দে ও হারুন্দে) এ সবই অতিজাগতিক মায়ায় ভরিয়ে দেয় আমাদের মাথাগুলি। লীলা মজুমদারের কিছু গল্পে আমরা ছোটবেলার স্বপ্নের মতো এই ঘোর-লাগা জগতটি আরো কয়েকবার খুঁজে পাব।

‘রাজকাহিনী’, তর্ক সাপেক্ষে অবন ঠাকুরের সেরা সাহিত্য-কীর্তি। ‘পদ্মিনী’ চ্যাপটারে এমন একটি জায়গা আছে যাতে ‘ভূত’ না থাকলেও অশরীরী উপস্থিতি আছে এবং তার আবেদন বা অ্যাপিল পাঠকের হাড়গুলি হিম ক’রে দেয়। চিতোরের রাণার কাছে যখন ‘উবর দেবী’ রক্তের খিদে জানান (‘ম্যায় ভুখা হুঁ’) তাতে হরর গল্পেরই এফেক্ট তৈরি হয়। ‘অশরীরী’ এখানে দৈব-শক্তি হিসেবে বর্ণিত যার আবির্ভাব অশুভ আগামী-র ইশারা দিয়ে যাচ্ছে। ...বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রঙ্কিণী দেবীর খড়গ’ গল্পেও ভূত নেই কিন্তু দৈবশক্তি আছে, আতঙ্ক সৃষ্টির কাজটি এখানেও ঘুরপথে করিয়ে নেওয়া হয়েছে। 

আরও পড়ুন
পাঁচকড়ি দে-র ‘সাইকো’ – অলৌকিক নাকি অবাস্তবে-থাকা মনের পাগলামির গল্প?

প্রমথ চৌধুরী

 

‘রেলগাড়িতে ভূত’ জিনিসটা বাঙালি লেখকদের অবসেশন বলা যায়। কোনও তালিকা প্রস্তুত করা হ’লে প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮ – ১৯৪৬) -এর ‘ফার্স্ট ক্লাস ভূত’ গল্পটি আশা করছি শুরুতেই থাকবে। সপ্রতিভ স্টাইলে লেখা চমৎকার গল্প।  ফার্স্ট ক্লাস কামরায় ভূতটি সাহেব, মাতাল ও নেটিভ-বিদ্বেষী। (...সত্যজিৎ রায় ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’ গল্পে একই থিম ফিরিয়ে এনেছিলেন মেজর ড্যাভেনপোর্ট-এর ‘ভূত’কে দিয়ে।) ... এহেন ভূতের উপদ্রবে বাঙালি প্যাসেঞ্জার কীভাবে নাকাল হলেন, সেই বিবরণ প্রমথবাবু দিয়েছেন।  মশকরার উপাদান থাকলেও গল্পটি কমিক নয় বরং ভালোরকম অস্বস্তির- সেই অস্বস্তি, যা দুঃস্বপ্নে হামেশাই লভ্য। 

আরও পড়ুন
বাংলা-র সবচেয়ে পুরোনো ভূতের গল্পটি কি আছে রূপকথার বইতেই?

মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৮-১৯২৯) বেশ কয়েকটি ভূতের গল্প লিখেছেন, ‘কংকালের টঙ্কার’ অন্য সবক’টিকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এখানেও রেলগাড়ি আছে, ভূতের বিয়ে আছে (‘ভূশণ্ডির মাঠ’ গল্পেও যা ছিল) এবং প্যাসেঞ্জার বাবুকে নিয়ে ভয়াল তামাশার আয়োজন হয়েছে। রয়েছে নিশুতি রাতের বিশ্বস্ত ডিটেল; গল্প পড়ে পাঠক হাসবে না ভয় পাবে এই নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যায়! ...জলজ্যান্ত প্যাসেঞ্জারবাবু যে ভূত নন তার প্রমাণ দিতে গিয়ে ‘জাঁদরেল’ (জনৈক ভূতের নাম) শব্দটি দিয়ে পদ্য ফাঁদতে হয় তাঁকে। ...মার্চিং সং-এর আদলে লেখা ‘সবসে বড়া হ্যায় জাঁদরেল জাঁদরেল’ – ননসেন্স ছড়াটি অবিস্মরণীয়। ‘কংকালের টঙ্কার’ আমাদের ভাষায় মৌরসী পাট্টা চাইলে তার দখল অবারিত থাকবে।

Powered by Froala Editor