স্বৈরাচার ঘুচিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি, ইউরোপের শেষ ‘ডিক্টেটরশিপ’-এর বিরুদ্ধে চলছে আন্দোলন

যখন সারা পৃথিবী স্তব্ধ, গৃহবন্দি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে। তখন অন্যদিকে অগ্নিগর্ভ বেলারুশ। পোল্যাড, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের গা ঘেঁষে থাকা ছোট্ট একটা ইউরোপীয় দেশ। অরণ্য, হ্রদ, জলভূমি সম্বলিত ছবির মত প্রাকৃতিক দৃশ্যে সাজানো এই বেলারুশ। বসবাস মাত্র ১ কোটি মানুষের। ১৯৯১ সালে আগস্ট মাসে স্বাধীন রাষ্ট্রের তকমা পায় বেলারুশ। তার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নেরই অংশ ছিল এটি। প্রতিষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক গণতন্ত্র। ১৯৯৪ সালে ভোটের পর প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা শুধু খাতায় কলমেই থেকে গেছে বেলারুশে। ১৯৯৪ থেকে আজও দেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি বা বলা ভাল ‘দেশনায়ক’ লুকাশেঙ্কোই। কারণ তারপর থেকে সুষ্ঠভাবে আয়োজিত হয়নি আর কোনো ভোট। চলে এসেছে স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র। ইউরোপের এই একমাত্র স্বৈরাচার শাসিত দেশ বেলারুশ মহামারীর এই কঠিন সময়েও লড়াই করে যাচ্ছে ‘মুক্তি’-র জন্য।

সামনের আগস্ট মাসেই ভোট বেলারুশে। আর ৯ আগস্টের সেই ভোটের জন্যই অগ্নিগর্ভ বেলারুশ। বিরোধীপক্ষের যে কোনোরকম প্রচার, র্যা লি কিংবা প্রতিবাদেই কড়া শাসন ব্যবস্থাকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন লুকাশেঙ্কো। পুলিশের গাড়ি মানেই এখনও আতঙ্ক বেলারুশে। সেইসঙ্গেই তৎপর দেশের গোয়েন্দা বিভাগও। পালিয়ে বাঁচবার পথ নেই। আর্মড সেনাবাহিনীও কখনও কখনও টহল দিচ্ছে সেখানে। কিছু বোঝার আগেই টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি করে নিয়ে যাচ্ছে বন্দিশালায়। তবে এসবের পরেও প্রতিবাদের কণ্ঠ চুপ নেই। এক নতুন জাগরণের দিকে চেয়ে বসে আছেন আশাবাদী মানুষেরা।

প্রেসিডেন্টের ভোটে লুকাশেঙ্কোর বিরোধী প্রার্থী হিসাবেই দাঁড়াচ্ছেন সেতলানা তিখানোভস্কায়া। ৩৭ বছরের এক সাহিত্যের শিক্ষিকা। তবে প্রথম থেকে বিরোধিতা করলেও প্রার্থী হিসাবে ভোটে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা ছিল না তাঁর। বিরোধীদের একাধিক মূল প্রার্থীদের মধ্যে ছিলেন তাঁর স্বামী সার্জেই তিখানোভস্কি, বেলারুশের একজন জনপ্রিয় ভ্লগার। কিন্তু ভোটে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করার মাত্র ২ দিনে মধ্যেই গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। গ্রেপ্তার করা হয় বাকি সম্ভাব্য প্রার্থীদেরই। তবে বিপ্লবের আগুন কি নিভতে দেওয়া যায়? এগিয়ে এসেছেন সেতলানা। তাঁদের অনুপস্থিতিতে দাঁড়িয়েছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে।

শুধুমাত্র মে মাসের পর থেকেই বেলারুশে বন্দি হয়েছেন ৭০০-র বেশি মানুষ। যাঁরা বিরোধী সমর্থক এবং সক্রিয় আন্দোলনকারী। অহিংসভাবেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে স্লোগান, হাততালি দিলেও গ্রেপ্তার হয়েছেন তাঁরা। হয়তো আরও মানুষের মনে সাহস, আন্দোলনের মন্ত্র ছড়িয়ে দিচ্ছেন বলেই তাঁরা শত্রু হয়ে উঠেছেন সরকারের। ছাড় নেই সংবাদিকদেরও। গত একমাসে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৭ জন সাংবাদিক। রয়েছেন বিদেশেরও কয়েকজন। ছোট্ট কনফাইনমেন্ট শেল, অকথ্য অত্যাচার। বাদ যাচ্ছে না কিছুই। কিন্তু তারপরেও চুপচাপ মেনে নেওয়ার ধৈর্য হারিয়েছে বেলারুশ।

আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের শেষতম বিচারে কারাদণ্ড ৯৩ বছরের নাৎসি বৃদ্ধের; জড়িয়ে ছিলেন ইহুদি হত্যায়

তবে আশ্চর্য লাগার কথা, একাধিক বিরোধী প্রার্থীকে গ্রেপ্তারের পরেও সেতলানাকে কীভাবে টিকিট পেলেন ভোটের? পেয়েছেন কারণ তিনি একজন মহিলা। আর মহিলার নেতৃত্বের ক্ষমতা থাকে না। এমনটাই বিশ্বাস স্বৈরাচারী লুকাশেঙ্কোর। প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো গত ২৯ মে ট্রাক্টর কোম্পানির শ্রমিকদের একটি সভায় প্রকাশ্যেই এই কথা ঘোষণা করেন। উল্লেখ করেন ‘পতনের মূল নারী’। ‘বেলারুশ এখনও পরিণত হয়নি একজন মহিলাকে ভোট দেওয়ার জন্য’। একথাও বাদ দেননি লুকাশেঙ্কো।

আরও পড়ুন
‘বিপ্লবকে অভিনন্দন’, মহিলাদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত আইনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে উদ্বেল সুদান

রাষ্ট্রপতির উক্তিগুলো মধ্যেই বোঝা যায় মহিলাদের প্রতি তাঁর মানসিকতা, বৈষম্যের মাত্রা। সেখানে একজন মহিলা হয়ে অবাধে টিকিট পাওয়ার পরেও যে ঝুঁকি নেই, একথা বলা যায় না। তবুও অসীম সাহসিকতার সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছেন সেতলানা। সেই সঙ্গে তিনি সন্ত্রস্তও। আতঙ্ক রয়েছে, তাঁর সন্তানদের যখন তখন তুলে নিয়ে যেতে পারে পুলিশ। হয়তো প্রাণেও মারতে পারে তাঁকে। পাশাপাশি গোয়েন্দাদের নজরদারি রয়েছে সবসময়ই। এমনকি বিদেশি কোনো সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাতেও আড়ি পাতেন গোয়েন্দারা। সেতলানা নিজেও স্বীকার করেছেন, হয়তো জয় আসবে না এবারেও। কারণ ভোট হলেও তা হবে পক্ষপাতদুষ্ট। কারচুপিও হবে সেখানে। কারণ সমস্ত ক্ষমতাই রয়েছে প্রেসিডেন্টের হাতে। তবে সময় যে ফুরিয়ে এসেছে, এই বার্তাটুকু দিতেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এই লড়াই, জানাচ্ছেন সেতলানা। আজ না হোক তো কাল এই স্বাধীনতা আসবেই। সমগ্র দেশের মানুষই আর চান না লুকাশেঙ্কোর শাসন।

আরও পড়ুন
পৃথিবীতে প্রথমবার, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে স্বীকৃতি পেলেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরাও

তবে লুকাশেঙ্কোর এখনও বিশ্বাস করেন দেশে রয়েছে ‘ফ্রিডম অফ স্পিচ’। তাঁর দাবি ইউরোপের অন্যান্য দেশে অননুমোদিত কোনো প্রতিবাদে কাঁদানে গ্যাস বা জল কামান ব্যবহার করা হয়। সেক্ষেত্রে বেলারুশের অবস্থা অনেকটাই খোলামেলা। আহত কিংবা জেলে বন্দি হলেও, মৃত্যুর মুখে ঠেলা দেওয়া হচ্ছে না কাউকেই।

আরও পড়ুন
স্বাধীন হয়েও ‘পরাধীন’, আজও ফ্রান্সকে নিয়মিত খাজনা দেয় আফ্রিকার ১৪টি দেশ

বেলারুশের মতই আরও অনেক দেশই পৃথিবীর মানচিত্রে অবস্থান করে, যেখানে আজও স্বৈরাচার চলছে। বিশেষত এশিয়া এবং আফ্রিকার কিছু দেশ। জয় আসুক কিংবা না আসুক। আগুনের জন্য প্রতিবাদের খড়কুটো একত্রিত করতে পেরেছে বেলারুশ। চেষ্টা করতে পেরেছে স্বাধীনতার মলাটে মোড়া পরাধীনতা থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু বাকিরা?

Powered by Froala Editor

More From Author See More