ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অজস্র ইতিহাস, তিলে-তিলে আর্কাইভ গড়ে তুলছেন প্রেসিডেন্সির পড়ুয়ারা

ইতিহাস তো শুধু বইয়ের পাতায় আটকে থাকে না। কয়েকশ বছরের ইতিহাসকে স্পর্শ করেও তো দেখা যায়। তার জন্য সবসময় মাটি খুঁড়ে প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করতে হবে না। ধরা যাক এই দেশের প্রাচীনতম আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রেসিডেন্সি কলেজ, থুরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই। ক্যাম্পাসের ভিতরে পা রাখলেই হয়তো আর ইতিহাসের স্পর্শ পাওয়া যাবে না, কিন্তু একটু ঘুরে দেখলেই সেসব ছড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে। গেট দিয়ে ঢুকলেই বাঁ দিকে চোখে পড়বে একটি ফলকে লেখা এক ব্যক্তির নাম। রাম ইকবাল সিং। না, এদেশের ইতিহাসের কেউকেটা কেউ নন তিনি। তবে ১৯২৯ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের এই প্রহরী। আর তাঁর স্মৃতিতেই কলেজের ছাত্ররা এই ফলক স্থাপন করেছিল।

ক্যাম্পাসের চারিদিকে ছড়িয়ে আছে এমন অসংখ্য ফলক, মূর্তি এবং ছবি। তার কোনোটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নাম, কোনোটার সঙ্গে জগদীশচন্দ্র বা নেতাজির নাম। আবার আইরিশ বিজ্ঞানী আর্থার কানিংহ্যাম তো মাত্র ৬ বছরেই এই প্রতিষ্ঠানের এক অতি আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যুর স্মরণেও প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও আরও অনেক সহযোগী উদ্যোগ নিয়ে একটি ফলক বসিয়েছিলেন। বেকার বিল্ডিং-এর সিঁড়িতে এখনও দেখা যায় সেটি। আবার প্রথমবর্ষের এক সহপাঠীর অকাল মৃত্যুতে স্মৃতিফলক বসিয়েছিল ইংরেজি বিভাগের পড়ুয়ারা। আর এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব ইতিহাসের চিহ্ন খুঁজে নিতে একটু তো সমস্যা হবেই। আবার গবেষণার জন্যও একটা সামগ্রিক চেহারা দেওয়া দরকার। আর সেই কাজটাই করল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বর্তমান পড়ুয়াদের একটি দল। ক্যাম্পাসের নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ইতিহাসকে এক জায়গায় জড়ো করে তৈরি করেছে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ। আর এটিই সারা দেশে প্রথম ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ প্রোজেক্ট, যার নেতৃত্বে আছে পড়ুয়ারাই।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া সৌরভ চট্টোপাধ্যায় এবং সোহিনী সেনগুপ্ত ছিলেন প্রকল্পের নেতৃত্বে, প্রোজেক্টটি মূল চেহারা পায় তাঁদেরই হাতে। ফলক, মূর্তির ছবি তোলা এবং প্রাথমিক তথ্য সংকলনে তাঁদের পাশে ছিলেন বাকিরা। আর পুরো কাজে পরামর্শদাতা হিসেবে ছিলেন ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সৌভিক মুখার্জি। এই প্রোজেক্টের কাজে কোনো ফান্ডিং নেই এই দলের, কোনো প্রথাগত স্বীকৃতিও আসেনি। সৌরভ জানালেন, “আপাতত একটা ফ্রি ওয়েবসাইটে কাজ হয়েছে। ফান্ডিং পেলে কাজের পরিসর আরও বাড়ানো যাবে।” শুধু এই প্রকল্পই নয়। কলা বিভাগের প্রায় প্রতিটি স্তরে ক্রমাগত আর্থিক সংকটের সঙ্গে লড়াই করে যেতে হয় গবেষকদের। এমনকি অনেকে তো মনে করেন, এইসব বিষয় নিয়ে পড়াশুনোর তো কোনো ভবিষ্যৎ নেই। প্রজেক্টের আরেকজন লিডার সোহিনী সেনগুপ্ত তাই মনে করছেন, “এমন পরিস্থিতিতে ডিজিটাল হিউম্যানিটিজ নতুন সম্ভবনার দরজা খুলে দিচ্ছে। গবেষণার কাজেও তো আধুনিকতার প্রয়োজন।”

ডিজিটাল হিউম্যানিটিজের চর্চার সঙ্গে কিন্তু বরাবরই জড়িয়ে আছে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ২০১২ সালে দেশের মধ্যে প্রথম এই বিষয়ে সেমিনারের আয়োজন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ। এমনকি সমস্ত বিভাগের পড়ুয়াদের জন্য এই বিষয়ে নিয়মিত কোর্সের ব্যবস্থা করেছে ইংরেজি বিভাগ। সেই তালিকায় এবার নতুন সংযোজন সৌরভ-সোহিনীর এই প্রকল্প। সেইসঙ্গে একটা ব্যতিক্রমী উদ্যোগও বটে। স্টোরি ম্যাপিং কিন্তু কোনো গবেষণাতেই বড় একটা ব্যবহার করা হয় না। অথচ ইতিহাসের সঙ্গে ভূগোলকেও মিলিয়ে দিতে চেয়েছে সৌরভ-সোহিনী। এমনকি কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর অথবা জন এডওয়ার্ড লায়েলের স্মৃতিফলকের মতো যেসব চিহ্ন চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে, তাদেরও একই আর্কাইভের মধ্যে জোড়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। হ্যাঁ, ছবির গুণমান হয়তো তেমন ভালো হয়নি, বা প্রথা মেনে কোনো মূর্তিরই ৩-ডি ছবি তুলতে পারেননি তাঁরা। তেমন যন্ত্রপাতিও নেই তাঁদের। কিন্তু চেষ্টাটুকু তো আছে। 

সেই চেষ্টার জোরেই জন্ম নিল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে তৈরি এই আর্কাইভ। তবে ভবিষ্যতে উপযুক্ত সাহায্য পেলে কলেজ স্ট্রিটে ছড়িয়ে থাকা আরও অনেক চিহ্নকেই আর্কাইভ আকারে জোড়ার পরিকল্পনা। তবে তা কতটা বাস্তবায়িত হবে, সময়ই জবাব দেবে...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণীরাও, জানাল প্রেসিডেন্সির ওয়েবিনার

More From Author See More