'মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই'

আগামী ২০ সেপ্টেম্বর রিলিজ করবে 'রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত'। তার আগে, সেই সিনেমা ও অন্যান্য আরও অনেক বিষয় নিয়ে, পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য্য-র মুখোমুখি অরিত্র দত্ত।

বাকিটা ব্যক্তিগত-র পর আপনার পরিচালিত ফিচার ফিল্ম রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত। এর মাঝে সময়ের এত ব্যবধান কেন?

দ্যাখো, তার কারণ আমি পেশায় এডিটর এবং পছন্দ মতো ছবি না হলে  পরিচালনা করি না। ফিল্মে আর্ট ডিরেক্টর, অভিনেতা, সিনেমাটোগ্রাফার সবার একটা মেলবন্ধন থাকে। সেটা সবসময় সম্ভব হয় না, যখন হয় তখন করি। যেমন এখন রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত-তে হল, তাই সময় বেশি লাগল।

আপনার ফিল্মে বরাবরই এমন একটা জায়গা দেখানো হয় যা কাল্পনিক; যেমন বাকিটা ব্যক্তিগত-র মোহিনী গ্রাম বা ঢেউ-এ সেই নদীর পাড়। ল্যান্ডস্কেপ সেখানে খুব প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়েছে। রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত-তে লোকেশনের ভূমিকা কী?

প্রথমত এর একটা এস্থেটিক দিক আছে। মূলত আমি ইন্ডোর থেকে বেরিয়ে শ্যুট করতে চাই। যেমন ধরো, মোহিনী। তারপর টেলিভিশনে একটা ফিল্ম শ্যুট করেছিলাম, গোয়েন দা, সেখানেও বাইরে শ্যুট করি। তবে হ্যাঁ, তা খুব চেনা জায়গায় নয়। আমি যে জায়গায় যাতায়াত করি, বারবার যাই, তার মধ্যেও যদি এক্সপ্লোর করা যায় – সেটাই মূল লক্ষ্য থাকে আমার। নিশ্চিতভাবে একটা সময়ের পরে আমাকে ইন্ডোরেই ফিরে আসতে হবে শারীরিক কারণে, এও আমি জানি। তাই যতটা এক্সপ্লোর করার, এখনই করে নেওয়া যাক।

ভালো স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, যা বেঁধে রাখবে, কোত্থাও মাথা সরাতে দেবে না। তাহলে হলমুখী দর্শক পাওয়া যাবে। যাবেই।

আপনার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার নেশা এখানে কতটা প্রভাব ফেলছে?

আমি কিন্তু খুব বেশি ঘুরতে পছন্দও করি না। এরোপ্লেনে চড়তে বেশ ভয় পাই, ট্রেনে ট্র্যাভেলও করাটা পছন্দের নয়। কলকাতা-তেহট্ট-বহরমপুর – এর মধ্যেই আমার এক্সপ্লোর। (হাসি)

আরও পড়ুন
'এই পাটুলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আমার কথাই বলছেন লালন' - সাত্যকি ব্যানার্জির সাক্ষাৎকার

এর আগেও বাংলায় রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত হয়েছে। তার সঙ্গে উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেনের মতো নাম জড়িয়ে। আপনার সিনেমা আগের সিনেমাটির থেকে কতটা আলাদা?

আমার চিত্রনাট্য শুধু সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত, সিনেমা থেকে নয়। এর ওপর কাজ করার ইচ্ছা বহুদিন ধরেই ছিল, চিত্রনাট্য লিখতে লিখতে আমিও বহুদূর চলে গেছি, আবার ফিরে আসতে হয়েছে। এই সিনেমা সাহিত্যের সঙ্গে পুরোপুরি এক নয়; যার জন্য প্রথমেই বলা – ‘অনুপ্রাণিত’। আমার তরফ থেকে শ্রীকান্তকে একটা ট্রিবিউট বলতে পারো।

তবে এই সময়টাকে ধরা কেন? ১৯২০ সালের পটভূমিকা কি নেওয়া যেত না?

পনেরো-ষোলো বছর ধরে আমি এই বিষয়টা নিয়ে ভেবে গেছি। তখন ভাবনা অবশ্য ছিল ওই সময় অর্থাৎ ১৯২০ সাল নাগাদ। কিন্তু তার যা প্রোডাকশন, তা পাওয়া দুষ্কর। তাই চিত্রনাট্যকে আমি এই সময়ে নিয়ে এসেছি। চরিত্র ও কাহিনিসূত্র সাহিত্য থেকে এলেও, তার চলন বা ভাষা পুরোটাই নিজস্ব।

অর্থাৎ soul...

Soul ঠিক বলা যাবে না. সেখানেও কোথাও আলাদা। না দেখলে বোঝা যাবে না।

ওয়েব সিরিজ টার্গেট অডিয়েন্স দেখে বানানো। সিরিজ দেখতে ভালো লাগলেও ক্ষণস্থায়ী। সিনেমার জায়গাটা নিতে পারবে না।

এতে কোথাও রক্ষণশীলতা আঘাত পাবে কি? 

লাগতে পারে, কিন্তু তাতে আমার কিছু করার নেই। আমি একজন ফিল্মমেকার, আমি সিনেমার ভাষায় কথা বলি। ভালো লাগা বা খারাপ লাগাটা সিনেমার ভাষা দিয়ে হলে ঠিক আছে, তার বাইরে হলে আর কী করা যেতে পারে!

প্রথম ফিচার ফিল্ম থেকে আজ এতটা সময় – স্ট্রাগলটাকে কীভাবে দেখছেন?

ফিল্ম মানে ফিল্ম – শর্ট, ফিচার, ডকুমেন্টরি যাই বল। আমি সবসময়ই কিছু না কিছু কাজ করে গেছি। তবে ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’-র সময় স্ট্রাগলটা বেশ কঠিন, অর্থনৈতিক ব্যাপারটাও ছিল তখন। আমার তখন একটাই কাজ ছিল। তবে দ্যাখো, মনে কষ্ট নিয়ে সিনেমা বানিয়ে লাভ নেই। ভালো লাগে তাই বানাই।

চলচ্চিত্রের ছাত্র হিসেবে, আপনার ভাষা তৈরি হয়েছে কোন ধরনের সিনেমা থেকে?

দূরদর্শনে যখন রেট্রোস্পেক্টিভ হত, সে-সময় সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা পরপর দেখানো হত। সেগুলো আমাকে টানত খুব। মনে আছে, ক্লাস নাইনে পড়ি, সেবার ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ দেখার পর স্কুলে গিয়ে ওই সিনেমায় জহর রায়ের গান বন্ধুরা মিলে খুব প্র্যাক্টিস করেছিলাম। বহরমপুরে তখন চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা দেখানো হয়েছিল; তার একটা সিজন টিকিট কেটে পরপর দেখার কথাও মনে পড়ে। 

কলকাতায় চলে আসার পরে উত্তম মঞ্চে পিসেমশায়ের সঙ্গে ‘ওয়েটিং ফর দ্য টেনার’ দেখেছিলাম। ফেস্টিভালে ওটাই প্রথম ছবি দেখা। তখন প্রতিদিন দুটো-তিনটে করে সিনেমা দেখি বসুশ্রী, উজ্জ্বলা, নবীনা, আরতি এই হলগুলোয়। মেসে থাকতাম এবং সিনেমা দেখার অভ্যাসটা ছিল। তারপর রূপকলাতে যাওয়ার পর লার্স ভন ট্রায়ারে ডগমা ফিল্ম দেখি। সেটা আমায় খুব প্রভাবিত করে।

রূপকলায় পড়ার সময় একটা ওয়ার্কশপ হয়, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন আমেরিকার এক বিখ্যাত ভিডিও আর্টিস্ট জন জস্ট। তিনি আমাদের হাতে ক্যামেরা দিয়ে বললেন, ক্যামেরাতেই এডিট করে একটা ফিল্ম বানাতে। মানে ধরা যাক, এই সিনটা এই অবধি লাগবে ব্যাস কাট্। আমি ফিচার করি, পরে সেটা ডিলিটও হয়ে যায়। কিন্তু সেই ওয়ার্কশপ বিশাল পরিবর্তন করে, আরো প্রিসাইস করে আমার চিন্তাগুলোকে। এটা হয়তো আগে কোথাও বলিওনি।

বাকিটা ব্যক্তিগত অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু হলে গিয়ে ক’জন? সবাই ইন্টারনেটে দেখেছেন।

আপনার কথায় যে সিনেমাহলগুলোর নাম উঠে এল, বেশিরভাগই আজ মৃত। সেটা তো বিশাল ক্ষতি...

অবশ্যই। কিন্তু আজ ব্যবসাটা সিনেমা হল ভিত্তিক নয় শুধুমাত্র। স্যাটেলাইট স্বত্ব, ডিজিটাল মার্কেটিং – আরও অনেক ফ্যাক্টর আছে। দক্ষিণের ঘটনা অন্যরকম, সেখানে কিন্তু লোকে সিনেমা দেখে। লাইন হয়, কিন্তু বলিউডের অনেক সিনেমাই ডিজিটাল বাজারে প্রচুর টাকা নিয়ে এসেছে। 

কমার্শিয়াল ও আর্ট ফিল্মের পার্থক্য কতটা? 

সিনেমা মানেই কমার্শিয়াল। ব্যবসা জড়িয়ে থাকে যদি, তাহলেই কমার্শিয়াল। তবে কী জানো তো, এই যে লোকে গ্রামের সিনেমা শহরের সিনেমা ফেস্টিভ্যালের সিনেমা - এভাবে ভাগ করে নিচ্ছে, তাতে সিনেমার ক্ষতিই হচ্ছে।

আপনার ছবির যে আলাদা দর্শক আছে, ছবি বানানোর সময় কি আপনি সেটা মাথায় রাখেন?

দর্শক যে আলাদা, তা আমি জানি। মানতে হয়তো চাই না। মনে হয় সবাই দেখুক। তাও মানতে তো হবে যে আলাদা দর্শক আছে। তবে আমার কাজ সিনেমা বানানো, সেটা আমি করে যাই।

আজ বিভিন্ন ওয়েব মিডিয়ামের দৌলতে, মানুষ ল্যাপটপ বা মোবাইলে সিনেমা দেখে নিতে স্বচ্ছন্দ। সেটা সিনেমার ভবিষ্যতকে কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে?

বাকিটা ব্যক্তিগত অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু হলে গিয়ে ক’জন? সবাই ইন্টারনেটে দেখেছেন। তবে হ্যাঁ, দিন সেদিকেই এগোচ্ছে; সবই ল্যাপটপ মোবাইল ভিত্তিক হবে। হলে শুধু ম্যাজিক চলবে। যা হয় এন্ড গেমের মতো ফিল্মে। লোকে ম্যাজিক দেখতে চাইবে। সেটা আটকাতে গেলে ভালো স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, যা বেঁধে রাখবে, কোত্থাও মাথা সরাতে দেবে না। তাহলে হলমুখী দর্শক পাওয়া যাবে। যাবেই। তবে এটাও ঠিক, কোয়ালিটি না দিতে পারলে হবে না। এটা স্ক্রলিং-এর যুগ। আসছে আর হারিয়ে যাচ্ছে। মনে থাকবে না। প্রচুর অপশন...

সিনেমা মানেই কমার্শিয়াল। ব্যবসা জড়িয়ে থাকে যদি, তাহলেই কমার্শিয়াল।

এটাও কি কারণ যে, লোকে টানা সিনেমা দেখতে চাইছে না? স্থিরতার অভাব?

এটা হতে পারে। কিন্তু তাও আমার বিশ্বাস, কন্টেন্ট ঠিক হলে লোকে ঠিক দেখবে। টানাই দেখবে।

এখন অনেক সিনেমা রিলিজের মুখ না দেখলেও অনলাইনে দেখা যায়। সেটাও তো ভালো!

অনেক সময় রিলিজ না করার জন্য টাকা বেশি দেওয়া হয়। এতে প্রোডিউসারের লাভ হয়, কিন্তু বাকি যাঁরা কাজ করলেন তাঁরা ঢাকা পড়ে যান। ওয়েব সিরিজ টার্গেট অডিয়েন্স দেখে বানানো। সিরিজ দেখতে ভালো লাগলেও ক্ষণস্থায়ী। সিনেমার জায়গাটা নিতে পারবে না।

আপনার চলচ্চিত্রে সঙ্গীতের প্রভাব অন্যভাবে এসে পড়ে। এটা কীভাবে?

আমি প্রচুর শুনি। সঙ্গীত আমার পছন্দের জিনিস। প্রতিদিনের অঙ্গ, তবলাও শিখেছি। তুলনামূলক ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল বেশি শুনেছি। সিনেমায় প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আমার যেটা মূল টার্গেট হয় তা হল, ভাষা যেন এক হয়। চলচ্চিত্রের ভাষা যেন অন্য না হয়ে যায়।

https://www.youtube.com/watch?v=wxkF0snszdE

রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত সিনেমায় সাত্যকি দুরন্ত কাজ করেছে। মোট সাতটা গান রাখা হয়েছে। এখানে যার যা গান, সে নিজের যন্ত্রানুষঙ্গ নিজেই পরিচালনা করেছে। সাত্যকির কাজ শোনার পর আমি ছিটকে গেছি। সাত্যকির কাজ এই সিনেমাটাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। সেটাও মনে হয়! আমি আমার বন্ধু-বান্ধব ছাড়া কাজ করি না। সেটাই আমার পছন্দ। যদি প্রোডিউসার রাজি হন, তাহলে যখন কমা, দাঁড়ি সহ সব এক থাকবে, তখনই সিনেমা করি। এরা সবাই আমার বহুকালের বন্ধু। তাতে কাজটা ভালো হয়। সিনেমাটা দেখলেও বুঝবে, অভিনয়ও কীভাবে অবাক করে।

More From Author See More