জগন্নাথদেব মণ্ডলের তিনটি কবিতা

মৃত্যু ঘনিয়ে আসা ইহুদি-চিকিৎসকের মতো সমস্ত ধারদেনা শোধ করে দেব।

চায়ের দোকানদার-৫০। বই কেনার টাকা-১২৫। অঙ্কুর দা পাবে-৩০০।

যেভাবে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়া বন্যায় ডোবা মানুষ গৃহের জন্তুর দড়ি উপড়ে দেয় সেভাবে ছেড়ে দোব সমস্ত টিউশনির ছেলেমেয়েদের।

বুড়ি মা কাঁদবে, বাপ, দিদিও। তিনদিনে শোক শেষ হয়ে এলে পড়শীরা বাড়ি বয়ে দিয়ে যাবে আতপচাল, সুমিষ্ট হলুদ কলা, প্রিয় সন্দেশ, চিনি, ছানা...

দ্বিতীয় বইয়ের কথা ভাবা হয় নি। শুধু কানের গোড়ায় শুনতে পাচ্ছি, জ্যাঠামশাই পড়ছেন - হে অর্জুন...।

জলপাত্র ঢনঢন। কেউ মাটিতে তীর গেঁথেও, পাইপ বসিয়েও জল তুলতে পারছে না। স্তর নেমে গ্যাছে।

তাই শুকনো হয়েই মরছি। মরণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আতাবনের ভিতর দিয়ে জ্বলন্ত উটের পিঠে যাওয়ার সময় সুখস্বপ্ন দেখছি-শুখা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমানের শুকনো গাছগুলির তলায় জলের কুঁজোর গা ঘামছে। সারি সারি টলোমলো দিঘিতে কান উল্টে যাওয়া পদ্মপাতা। জোনাকি নাচছে।

এইবার চোখ উল্টে মরে গেলাম। তেষ্টায় ছাতি ফাটা, শুধু তিলকর্পূর খাওয়া পূর্বপুরুষ হয়ে গিয়ে প্রার্থনা করছি যাতে আমার বংশধর,কলোনির সবাই নলকূপে যথেষ্ট পানি পায়।

হে নাথ, আমার লক্ষযোনি ভ্রমণপ্রিয় আত্মার জলীয়অংশ উষ্ণদেশে বৃষ্টি হয়ে ঝরুক! 

হে দেবী, তোমার ত্রিনয়ন সদা জাগ্রত থাক মোর সংসারপানে। ওড়পুষ্পে অঞ্জলি দিতেছি, পাকশালে রোহিতমৎস্যের ঘ্রাণ হউক, ইলিশের ঝুল।

ঘু ঘু উড়ে যাক ভিটে থেকে, আঙিনায় আনন্দগান আসুক দোয়েল কোকিলের।

তোমার অপরূপনিতম্ব মঙ্গলঘটে অধিষ্ঠিত হোক। আম্রপল্লব দেব, গুয়া, পান। বরাভয় হাতে বসত করো এই ঠায়।

এবারে আমারে বলো মঙ্গলদায়িকা, আমার নারীমাংসে বমন আসে কেন? কদমকোরক স্তনে কেন উদাসীন থাকি? বেউশ্যার যোনিতে ময়ূরউল্কি দেখে কেন ভয় পায় মোর লিঙ্গসাপ?

হে হরপত্নী বর্ণনা করো, অই সুপুরুষ তাঁতিপুত্রে মন ধায় কেন? রাতে স্বপ্ন আসে মসলিন শাড়ির, ওর বাঁকা তেলাকুচোফল সম নাসিকা! কটা চোখ। গভীর দেহ ভেবে স্বেদজল খসে!

আমি পুরুষরূপে প্রকৃতি হই
জানিনে তাঁতিপুত্র বই
কী হইবে উপায় আমার।।

হে ধূমাবতী, ছাগ মাংস বলি দিতেছি, খড়গে আঁকছি সিন্দুরচোখ, পরিবার আমায় বদ্যির তিক্ততরল না যেন খাওয়ায়!

কাষ্ঠবেড়ালি প্রণাম করছে কনকগোসাপকে। তাঁতিপুত্রের গৌররঙের মতো রৌদ্র উঠছে। আকন্দবন। উইঢিপি।

দেবী, আপনার প্রসন্নতার মতো উনকোটি পবন।
এবারে বলো চণ্ডী, মোর নির্জনদেহ কী চলে যাবে একা অরণ্যে? বৈতরণীতে ভেসে যাবে প্রেমহীন একাশব?
নাকি আশ্রয় পাব নাগর নাগরতাঁতির সুন্দর কোল।

তোমার পুরুষনাভির গহনগর্ত থেকে নীচে নেমে গেছে এক সুন্দরঅরণ্য। সেখানে সরল গাছের ঘুম ঘুম গন্ধ। একটু দূরে নীলমোষের শিংয়ের মতো বাঁকানো টলটলে পুকুর; পুকুরের পাশে দুখানি গোলাকার ফর্সা স্ফটিক শুয়ে আছে। এর মাঝে সুন্দর একখানি বুনোজাম বর্ণের ফুটে থাকা পুরুষপদ্মফুলবিশেষ যার অগ্রভাগ সকালবেলার শাদা আলো অথবা ছাড়িয়ে রাখা লিচুর মতো ঝকঝক করছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে এইসমস্ত। আর তুমি তার সামনে আশিরনখ নগ্ন হয়ে শুয়ে আছ কলাপাতার উপর।

উল্টোরথের মধ্যরাত্রি শেষ হয়ে আসছে। আকাশে ফকিরমালার পাথরের মতো নক্ষত্রদল। এমনি জলের অথবা বারিপতনের শব্দ যেন পাথরচাপরির মেলা শুরু হয়েছে।

তোমার কিশোর বয়সে অই পদ্মফুল ফুটিয়ে দিয়েছিল বৃদ্ধ রহমান চাচা। আখখেতে লুকিয়েছিলে ভয়ে। বাড়িতে সেদিন উৎসব। ছোটমামা সাইকেল দিয়েছিল, নানি হাতঘড়ি।

এবারে সে হাঁমুখে নিল তোমার প্রস্ফূটিত থলকমলের ফুল। তার গালে, মুখে পোস্তদানার মতো পুংপুষ্পরেণু লেগে যেতে লাগল। কচি পেয়ারার স্বাদ। গলার দিকে চালিত হচ্ছে। বাইরে আষাঢ়ের বৃষ্টি।

তীব্র এই নির্জন কাঠের বাড়ির ভিতর আরাম শব্দ আর মুখমৈথুনের বুনোগন্ধে দুটি দাঁড়াশ পঞ্চায়েত থেকে বসানো নলকূপের ওখানে পরস্পরকে পেঁচিয়ে কনকসাপ হয়ে যাচ্ছে।

সে সুর্দশনচক্র ছুঁয়েছে এবারে তোমার। বুনো বাঘের গর্ভঘ্রাণ। তাঁর মুখঠোঁটহাতপাস্তনবৃন্তনিতম্ব নিমিষে ঝরে ঝরে পড়ছে এদিক ওদিক।

সেখানে সেখানে আলো জ্বলছে। তুমি পাথরের শিব হয়ে রক্ষা করছ ওইসব ওইসব ছিন্নভিন্ন অঙ্গ।

তারপর ভোর হতে ওজু শেষ করে আজানপাটিতে বসছ। ঘরে ঢুকে দেখছ মেঝেয় অইসব অঙ্গ একটি করে নমেরু হয়ে গেছে। সেই সোনার জোড়াসাপ এসে আড়াল করছে তোমাদের গোপন প্রণয় আর ঝরা রুদ্রাক্ষের জঙ্গল।

তুমি ভৈরবের মতো নমেরুর মালা গেঁথে পুরুষবুকে ঝুলিয়ে রাখছ আর দুলছ ধ্যানের মতো যেন একখানি বড়সড় জ্যান্ত ধুতুরার গাছ।

মাটির পাত্র থেকে ঝিমঝিম তৃপ্ত ধূপ অথবা মৃদুআতরের গন্ধ উঠছে।