প্রাকৃতিক দুর্যোগ মিলিয়ে দিল জলহস্তী আর কচ্ছপকে, এমনই বিস্ময়ের সাক্ষী মোম্বাসা

জঙ্গলে হোক বা চিড়িয়াখানায়, পশুরা সবসময় নিজের প্রজাতির সঙ্গেই মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে। তাদের এলাকাও থাকে স্বতন্ত্র। কিন্তু এর মধ্যেই দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা কি একদমই অসম্ভব? রূপকথার গল্পে অবশ্য এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। কিন্তু বাস্তবে এমন ঘটনা অসম্ভব না হলেও, অস্বাভাবিক তো বটেই। অন্তত প্রাণীদের অভ্যাস নিয়ে গবেষণা করেন যাঁরা, তাঁরা এতে বেশ অবাকই হন। ঠিক এমনই একটি রূপকথার মতো ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে ঠিক ১৫ বছর আগে। ঘটনাটি ঘটে পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়ার উপকূল অঞ্চলের একটি অভয়ারণ্যে। সাংবাদিক জেনিফার লাডেনকে সেই গল্প শুনিয়েছিলেন লাফার্জ ইকোসিস্টেমের জেনারেল ম্যানেজার ডা. পওলা কাহাম্বু।

ঘটনাটি ঘটে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর। ঠিক যেদিন সুনামির ধাক্কায় কেঁপে উঠেছিল ভারত মহাসাগরের সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়ার উপকূল অঞ্চল। ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সুনামির ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল ৪০০০ কিলোমিটার দূরে কেনিয়ার উপকূলে। অবশ্য ততক্ষণে সেখানে শুরু হয়ে গিয়েছে আরেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রবল বৃষ্টিপাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে জঙ্গলের অসংখ্য প্রাণী। উদ্ধারকারী দল যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছয়, তখন বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে।

জঙ্গলে পৌঁছে উদ্ধারকারী দলটি দেখে একটি সদ্যোজাত জলহস্তী অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার পরিবারের আর সবাই বৃষ্টির তাণ্ডবে দিশেহারা হয়ে পালিয়েছে। কেবল এই ছোট্ট শিশুটি পালাতে পারেনি। তার চোখেমুখে তখন ক্ষুধা এবং আতঙ্কের চিহ্ন। খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত ডা. কাহাম্বু নিজেও। সরকারের অনুরোধ মতো লাফার্জ ইকোসিস্টেমের অভয়ারণ্যে তাকে রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে দলটি রওয়ানা দেয় মোম্বাসার উদ্দেশ্যে।

শিশু জলহস্তীর মুখচোখে কিন্তু তখন অবিশ্বাস স্পষ্ট। এমনকি মোম্বাসার অভিয়ারণ্যে পৌঁছেও সে বিশ্বাস করতে পারছিল না এই মানুষদের। এমন সময়ে কাছের একটি জলাশয়ে দেখতে পেল একটি ১৩০ বছরের বৃদ্ধ দৈত্যাকার কচ্ছপকে। সে এই জঙ্গলের বেশ পুরনো সদস্য। নাম মুজি। শিশু জলহস্তী, যার নাম ততক্ষণে দেওয়া হয়েছে 'ওয়েন', মুজিকে দেখেই দৌড়ে গেল তার দিকে। তার শক্ত খোলের আড়ালে যেন লুকিয়ে থাকতে চেষ্টা করছিল। ঠিক যেমন ছোট জন্তুরা করে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। ওয়েনের এহেন আচরণে মুজিও মজা পেয়ে গিয়েছিল। আর তারপরেই শুরু হল দুজনের খেলা।

মুজি আর ওয়েনের বন্ধুত্ব তৈরি হতে এক ঘণ্টা সময়ও লাগেনি। তারা ওই পুকুরের মধ্যেই একসঙ্গে থাকতো। বিকেলের রোদ মেখে খেলা করত দুজনে। মাঝে মাঝে একসঙ্গে হাঁটতেও বেরোতে। মুজির থেকে ওয়েনের গতিবেগ ছিল বেশি। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। এভাবেই দিন কাটছিল। ক্রমশ তাদের খবর ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। অনেক উৎসাহী মানুষ তাদের নিয়ে তথ্যচিত্র বানানোর কথাও ভাবতে শুরু করল। এতে অবশ্য দুই বন্ধুই বেশ বিরক্ত হচ্ছিল। তারপর একদিন অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষ ঠিক করে, ওয়েনকে অন্য একটি পুকুরে অন্যান্য জলহস্তীর সঙ্গেই রাখা হবে। দুই বন্ধুর জীবন ৬ মাসের বেশি একসঙ্গে কাটেনি। কিন্তু এর মধ্যেই তারা জন্ম দিয়েছিল এমন এক রূপকথার, যা বিশ্বাস করতে অনেকেই দ্বিধা করতে পারে। দিনে দিনে অন্যান্য জলহস্তীর সঙ্গেও অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ওয়েন। সময়ের নিয়মে মুজির মৃত্যু হল একদিন। কিন্তু তাদের এই বন্ধুত্বের কাহিনি অমর হয়ে থেকে গেল ডা. কোহাম্বার বয়ানে।