যিশুর ক্রুশের পেরেক আবিষ্কার জেরুজালেমে, লেগে রয়েছে হাড়ের গুঁড়োও!

কয়েক বছর আগেই জেরুজালেমে পাওয়া গিয়েছিল জং ধরা দুটি পেরেক। যার আনুমানিক বয়স হিসাব করলে দেখা যায়, প্রথম শতাব্দীতে ব্যবহৃত হয়েছিল সেই পেরেকগুলি। আর সেই প্রসঙ্গেই জন্ম নিয়েছিল একটি বিতর্ক। যিশুখ্রিস্টের ক্রুশবদ্ধকরণেই কি ব্যবহৃত হয়েছিল সেগুলি? একাংশের দাবি ছিল তেমনই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা মানতে নারাজ ছিলেন তা। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা আরও একবার উসকে দিল সেই বিতর্ককেই। হাতে এল চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট, প্রমাণ। যার ভিত্তিতে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের একাংশ নিশ্চিত হয়ে উঠলেন, এই পেরেক যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণেরই।

এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত মুখ্য গবেষক আরেয়া শিমরন জানান প্রথম শতাব্দীর প্রথমভাগেই ব্যবহৃত হয়েছিল পেরেকগুলি। এবং তা ক্রুশিফিকেশনের জন্যই। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জং ধরা লোহার পেরেকের গায়ে অস্তিত্ব পাওয়া গেছে কাঠের গুঁড়ো এবং ক্যালশিয়াম কার্বোনেটের। যা সূচিত করে মানব-হাড়কেই। তবে ক্রুশে বিদ্ধ মানুষটিই যে যিশু, তা এখনও অবধি নিশ্চিত করে বলতে নারাজ শিমরন। পাশাপাশি ৩৩ শতাব্দীতেই যে ব্যবহৃত হয়েছিল এই পেরেকগুলি, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি বলেই জানাচ্ছেন তিনি।

কিন্তু কীভাবে পাওয়া গিয়েছিল পেরেক দুটি? আর কেনই বা নতুন করে সেই বিতর্ককে উসকে দিল এই গবেষণা? ইজরায়েলি নৃতত্ত্ববিদ নিকু হ্যাস ১৯৮৬ সালে একটি বাক্সে করে তেল হাভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান এই পেরেকগুলি। ৭০-এর দশকে ইজরায়েল অ্যান্টিক অথরিটির হয়ে খননের সময় তিনি খুঁজে পান এগুলি। সেসময় তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সায়াফাসের সমাধি। সেখানে মোট ১২টি কফিন উদ্ধার করা হয়েছিল। তার মধ্যে স্বয়ং সায়াফাসের সমাধির মধ্যেই ছিল এই পেরেকগুলি, এমনটা দাবি করেছিলেন তিনি। তবে পেরেকগুলি সংগ্রহ করলেও কফিনগুলি যথাস্থানেই রেখে এসেছিলেন নিকু হ্যাস।

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, যদি যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের সঙ্গে যোগ থাকে এই পেরেকগুলির, তবে অন্য কোনো ব্যক্তির সমাধিতে তাদের পাওয়া গেল কেন? প্রসঙ্গত, বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুযায়ী সায়াফাস ছিলেন তৎকালীন সমাজের প্রধান ইহুদি পুরোহিত। ম্যাথিউয়ের গসপেল অনুযায়ী যিশুর বিচার করেছিলেন সায়াফাস। ছিলেন পিলেটের অন্যতম তদারকদের মধ্যে একজন। 

গল্প অনুযায়ী, শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হাড় সংগ্রহ করে রাখতেন সায়াফাস। আর যিশুর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল নাকি তেমনটাই। যিশু ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর ক্রুশের পেরেকগুলি তিনি কৃতিত্বের নমুনা হিসাবেই রেখে দিয়েছিলেন। যা পরবর্তীতে তাঁর দেহের সঙ্গে একই কফিনে সমাধিস্থ করা হয় বলে ধারণা একাংশের।

কিন্তু ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে যখন শিমরন খুঁজে পাচ্ছেন পেরেকের ওপর পলি আর জীবাশ্ম হয়ে যাওয়া পাথরের আস্তরণের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কাঠ আর ক্যালশিয়াম কার্বোনেটের স্ফটিক (হাড়), সেই সময়টা ২০১৯। তখন আর বেঁচে নেই নিকু হ্যাস নামের সেই নৃতাত্ত্বিক। যাঁর দাবি ছিল সায়াফাসের সমাধি থেকেই পেয়েছিলেন এই পেরেক। অগত্যা আরও কিছু পরীক্ষা।

আরও পড়ুন
'২৫ ডিসেম্বর যীশুর জন্মদিন নয়', ক্রিসমাস উদযাপনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন খোদ খ্রিস্টানরাই

পেরেকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শিমরন খুঁজে পেলেন পেরেকের গায়ে একধরণের ছত্রাকের আস্তরণ। যা ইজরায়েলের অন্য কোনো সমাধিতেই পাওয়া যায় না। সেই ছত্রাকই মিলিয়ে দিল সময়সীমাকে। সায়াফাসের সমাধি যেখানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, অঞ্চলটি প্রায়শই প্লাবিত হয়। যার কারণেই এই ছত্রাকের আস্তরণ পড়েছে, পরে নিশ্চিত করেন শিমরন। সেইসঙ্গে সায়াফাসের সমাধিতে গিয়ে তিনি খুঁজেও পান বহু পুরনো ক্ষয়িভূত মানুষের হাড়ে ভরা একটি সিন্দুক। পরিষ্কার হয়ে যায় পুরো চিত্রটাই। 

তবে এক রহস্যের সমাধান করেও, নতুন রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়েন শিমরন। এতদূর অবধি খানিকটা নিশ্চিত হয়েই বলা যাচ্ছিল ওই পেরেক হয়তো যিশুর ক্রুশেরই। তবে নতুন হাড় বোঝাই বাক্স আবিষ্কারের পর শিমরন নিজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই তুলে আনেন পাল্টা-যুক্তি। যদি প্লাবিত হয়েই থাকে গোটা অঞ্চলটি, তবে ক্যালশিয়াম কার্বোনেট অর্থাৎ হাড়ের টুকরোগুলির আস্তরণ পড়ার পিছনে দায়ী থাকতে পারে সায়াফাসের সেই সিন্দুকটিও। আর সে কারণেই যিশুরই ক্রুশের হাড় এ কথা দাবি করা যায় না চূড়ান্তভাবে।

আর্কিওলিক্যাল ডিসকভারি জার্নালে জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়েছে শিমরনের এই গবেষণাপত্র। সেখানে শিমরন উল্লেখ করেছেন একজন বিজ্ঞানী হওয়ার দরুন উদারমনস্ক থাকা দরকার। ঠিক সেই কারণেই পেরেকগুলি যিশুর ক্রুশের, বলা উচিত নয় এখনই। সম্ভাবনা রয়েছে। তবে নিশ্চিত করে বলতে গেলে এখনও বিস্তর নমুনা এবং যুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর ৪৬৭ বছর পরেও দেহ প্রায় অবিকৃত, গোয়ায় শায়িত এই ‘অলৌকিক’ খ্রিস্টান সাধু

শেষ হয়েও যেন শেষ হল না একটা রহস্যের। তবে শিমরন মানতে না চাইলেও, ইজরায়েলিদের একাংশের মতে যিশুর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই পেরেকগুলির ইতিহাস। তাঁদের কাছে এখন পরম ‘পবিত্র’ এই প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ...

Powered by Froala Editor

More From Author See More